Advertisement
E-Paper

ফেটানোতেই ফোটে গয়না বড়ির নকশা

জিআই থাকুন বা না-ই থাকুন, গয়না বড়ি মেদিনীপুরের নিজস্ব। নকশাদার এই ভোজ্য গৃহিণীদের যত্ন আর নৈপুণ্যে কেমন করে শিল্প হয়ে ওঠে? খোঁজ নিলেন শমিকা মাইতিজিআই থাকুন বা না-ই থাকুন, গয়না বড়ি মেদিনীপুরের নিজস্ব। নকশাদার এই ভোজ্য গৃহিণীদের যত্ন আর নৈপুণ্যে কেমন করে শিল্প হয়ে ওঠে? খোঁজ নিলেন শমিকা মাইতি

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:০৯
বিয়ের তত্ত্বে গয়না বড়ি। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস

বিয়ের তত্ত্বে গয়না বড়ি। ছবি: পার্থপ্রতিম দাস

‘দূর বড়ি বুঝি এখন দেয়? বড়ি দেয় সেই মাঘ মাসে। নতুন কুমড়ো নতুন কলাইয়ের ডাল উঠলে। মিথ্যে কথা বলিসনি সুবি।

-মিথ্যে বলিনি। পুরনো ডালের বুঝি বড়ি হয় না?’

(দেবযান, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়)

‘পুরনো ডালের বড়ি হয় না’ কথাটা অর্ধসত্য। ‘পুরনো ডালে গয়না বড়ি হয় না’ বললে সবটা সত্যি হয়। গয়না বড়ির কৌলিন্য এমনই।

গয়না বড়ির রূপে-গুণে মজেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ‘গহনা বড়ি শুধুমাত্র দেখার জন্য, খাওয়ার জন্য নয়’, এমনটা নাকি বলেছিলেন তিনি। ইতিহাস সাক্ষী। ভূগোলও পাশে থাকবে গয়না বড়ির। এই নকশাদার খাদ্যদ্রব্যটি একান্তভাবেই পূর্ব মেদিনীপুরের। ঐতিহ্যবাহী। প্রস্তুত প্রণালী, নকশা এবং স্বাদ— সবেতেই স্থান মাহাত্ম্য মিলেমিশে রয়েছে। তাই এই বড়ির ভৌগোলিক পরিচয় নিশ্চিত করতে ‘জিওগ্রাফিক্যাল ইন্ডিকেশনস’ (জিআই) পাওয়া জরুরি। পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক রশ্মি কমল জানিয়েছেন, জিআই পেতে প্রশাসনিক স্তরে কোনও উদ্যোগ করা হয়নি। তবে আবেদন করতে চাইলে সাহায্য করা হবে।

জিআই মোড়ক না থাকলেও কিন্তু বড়ি নামক খাদ্যদ্রব্যটি একান্তই বাঙালির। জন্ম বনেদি হাতের নৈপুণ্যে। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক, মহিষাদল, কাঁথি এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল মহকুমায় বনেদি বাড়ির গৃহিণীরা গয়না বড়ি তৈরি করেছিলেন। মহিষাদলের লক্ষ্যা গ্রামের মাইতি পরিবারের শরৎকুমারী ও হিরণ্ময়ীদেবীর তৈরি শৈল্পিক গয়নাবড়িতে অভিভূত হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ সিনেমায় ময়না রাজ পরিবারের পাঠানো গয়না বড়ি ব্যবহার হয়েছিল। ডাল এক রাত ভিজিয়ে রেখে পরদিন ভাল করে শিল-নোড়ায় বেটে ফেটাতে হয়। যত ফেটানো হবে, তত বড়ি হালকা আর মুচমুচে হবে। শীতের মরসুমে ‘মশলা বড়ি’ দেন অনেকে। মেচেদার হাকোলা গ্রামের স্বপ্না পালিত জানালেন, লঙ্কার বদলে ডালবাটার সঙ্গে মরিচ গুঁড়ো আর কালো জিরে মেশান তাঁরা। বড়ি ধবধবে সাদা করতে সামান্য ফুলকপি বেটে মেশানো হয়।

মশলা বড়িরই আরেক রূপ ‘কুমড়ো বড়ি’। তবে, সকলের সেরা গয়নাবড়ি। পূর্ব মেদিনীপুরের একান্ত নিজস্ব। খাদ্যদ্রব্যের পরিচিতি ছাড়িয়ে লোকশিল্পের রূপ নিয়েছে। নন্দলাল বসুর কথায়, ‘নকশাগুলি সত্যই শিল্পের একটি উৎকৃষ্ট নিদর্শন। বঙ্গমাতার ভাঙা ঝাঁপিতে এই অমূল্য রত্নের সন্ধান পাইয়া আমরা মুগ্ধ হইলাম।’ শীতের মরসুমে তমলুক, মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, সুতাহাটা, ময়না, পাঁশকুড়া এলাকায় বাড়ি বাড়ি এই ‘অমূল্য রত্ন’ তৈরি হয় নিষ্ঠা সহকারে। বংশ পরম্পরায় চলে আসা কিছু কৌশল আর নিপুণ হাতের কারিকুরিতে অনন্য সে শিল্পকলার শুভারম্ভ হয় কার্তিক মাসের পোড়া অষ্টমীর দিন। কারণ, বিউলির কলাই এই সময় মাঠ থেকে ঘরে ওঠে। দোকানের খোসা ছাড়ানো বিউলির ডালে গয়না বড়ি ভাল হয় না। সদ্য মাঠে ওঠা গোটা বিরি কলাই দিয়ে বড়ি বানালে তবেই তা পাখির পালকের মতো পলকা, নরম আর মুচমুচে হয়। সঙ্গে যথেষ্ট পরিমাণে পোস্ত। মূল এই উপকরণ ছাড়া কাঁসার থালা, ডাল বাটা ফেটানোর জন্য বড় গামলা আর বড়ি দেওয়ার জন্য মাঝারি আকারের রুমালের মতো একটুকরো মোটা কাপড় বা প্লাস্টিকের টুকরো লাগে, যার মাঝখানে থাকে গোল ছিদ্র। আগে ছিদ্রটিকে ঠিকঠাক গোল রাখার জন্য পরিধি বরাবর সেলাই করে নেওয়া হতো। এখন চোঙ বেরিয়ে গিয়েছে বাজারে। ধাতব এই চোঙের মুখ সরু-মোটা-মাঝারি, নানা আকারের হয়। মশলা বড়ি বা সাধারণ বড়ি দেওয়ার জন্য মোটা মুখ লাগে। গয়না বড়ির ক্ষেত্রে কিন্তু সরু মুখ।

পূর্ব মেদিনীপুরের গয়নাবড়ির এত নামডাকের পিছনে রয়েছে খুঁটিনাটি নানান কৌশল। আগের দিন বিকেলে গোটা বিরিকলাই যাঁতায় ভেঙে পাছড়াতে হবে কুলোয়। এরপর ডাল জলে ভেজানো হয়। পরদিন ভোরবেলায় বিরিকলাই বস্তায় ঘষে ভাল করে ধুয়ে নিলে খোসাগুলো আলাদা হয়ে ভেসে ওঠে। সেগুলো সরিয়ে ডাল ভাল করে ধুতে হবে। খুদ, খোসা বা অন্যকিছু যেন মিশে না থাকে। দোকান থেকে খোসা ছাড়ানো বিউলির ডালে গুণমানে ঘাটতি হয়।

মিহি করে ডাল বেটে শুরু আসল কাজ, ফেটানো। বড় গামলায় ফেটাতে হয়। যত ফেটানো হবে তত ফুলে উঠবে ডালবাটা। শেষ দিকে ফোমের মতো হয়ে যাবে। একটু ডাল বাটা নিয়ে এক বাটি জলে ফেলে দেখতে হয়। ভেসে উঠলে বোঝা যাবে কাজ হয়েছে। ডাল একেবারে তুলোর মতো হয়ে গেলেও বড়ি দেওয়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত ফেটিয়ে যেতে হবে। এই কারণে গয়না বড়ি দেওয়ার জন্য অন্ততপক্ষে দু’জন লাগে। একজন ফেটাবে, একজন বড়ি দেবে। পুরো মাখাটা এক সঙ্গে ফেটাতে নেই। খেপে খেপে নিয়ে ফেটাতে হয়। ফেটানো কিছুটা হয়ে এলে তারপর নুন দিতে হয় স্বাদমতো। কোনও মশলা নয়। বাটতে বাটতে শিলে জল দেওয়া যাবে না। হাকোলার সঞ্চিতা পালিত কথায়, “মাখা আঁটো হলে ভালভাবে নকশা দেওয়া যাবে। নয়তো নকশা থেবড়ে যাবে। রোদে শুকানোর সময় বড়ি ফেটেও যাবে।”

ফেটানো শেষ হয়ে এলে পরিষ্কার কাঁসার থালার উপর বিছিয়ে দিতে হবে পোস্ত। থালার কোনও অংশ যেন না-দেখা যায়। এবার ডাল মাখা পুঁটলিতে হাতের চাপে নকশার প্যাঁচ পড়বে পোস্তর আস্তরণে। কখনও বৃত্ত, কখনও উপবৃত্ত, কখনও ত্রিভুজ কখনও বর্গক্ষেত্রের মতো দেখতে এই নকশাগুলো কোনওটা মুকুট তো কোনওটা নেকলেস, দুল, বাজুবন্ধ, লকেট, কানপাশা। কখনও আবার টিয়া, ময়ূর, হাঁস, প্রজাপতি, কখনও পাতা, ফুল-ফল। নকশা একটু বড় হলে দেখতে ভাল হয়। কিন্তু কড়ায় ভাজতে অসুবিধা তাতে। মাঝারি আকারের গয়না বড়ির সুবিধা সব দিক দিয়ে বেশি। একটা নকশার প্যাঁচ হয়ে গেলে তা শেষ করার জন্য অন্য হাতে ধরা থাকে সরু নারকেল কাঠি। সেই কাঠি দিয়ে লেইয়ের ধারা কেটে পরের বড়ি দেওয়া শুরু করা হয়। তবে সুদক্ষ বড়ি কারিগরদের নতুন নকশা শুরু করার জন্য কাঠি দিয়ে কাটার দরকার পড়ে না। মহিষাদলের বাসিন্দা কুসুম মাইতি বলেন, “নকশা এমনভাবে দিতে হবে যেন একের সঙ্গে অন্যটা লেগে না যায়, আবার থালায় বেশি ফাঁকা জায়গাও না থাকে। বড়ির প্যাঁচের শুরু-শেষ, বোঝা যাবে না বাইরে থেকে।’’

শীতের সকালের হালকা রোদ বড়ি শুকনো করার আদর্শ। কড়া রোদে বড়ি ভেঙে যায়। চড়া রোদে পাতলা কাপড়ে ঢেকে দিতে হয়। এক দিক ভাল করে শুকিয়ে গেলে আলতো হাতে বা খুন্তি দিয়ে সাবধানে উলটে দিতে হয় অন্য পিঠ। শুকিয়ে গেলে সযত্নে উপর-নীচে কাগজ বিছিয়ে কৌটোবন্দি করতে হয় অতি-ভঙ্গুর বস্তুটিকে। কৌটো খুলে ছাঁকা তেলে ফেলা। তারপর গরম ভাতের সঙ্গে মুগের ডাল আর পোস্তময় গয়নাবড়ি ভেঙে খাওয়ার তৃপ্তিই আলাদা। বিকেলে সুগন্ধী পাতা চায়ের সঙ্গে ‘টা’ হিসেবে গয়না বড়ি।

রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন। গয়না বড়ি শুধু দেখা যায় না!

Gahana bori Naksha Bori Geographical Indications GI গয়নাবড়ি
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy