E-Paper

বিস্মৃতিতেও অমলিন গীতার লড়াই

প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালেই এইচ ডি দেবগৌড়ার সরকার সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ করে।

আনন্দ মণ্ডল , দিগন্ত মান্না

শেষ আপডেট: ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:১৬
তমলুক শহরের মালিজঙ্গল পল্লির এই বাড়িতেই থাকতেন গীতা মুখোপাধ্যায় (ইনসেটে) ।

তমলুক শহরের মালিজঙ্গল পল্লির এই বাড়িতেই থাকতেন গীতা মুখোপাধ্যায় (ইনসেটে) । ছবি : পার্থপ্রতিম দাস

তিনি ছিলেন মনেপ্রাণে বামপন্থী। দীর্ঘ সাতাশ বছর আগে পাঁশকুড়ার সাত বারের সাংসদ, সিপিআই নেত্রী গীতা মুখোপাধ্যায়-ই প্রথম লোকসভা-বিধানসভায় মহিলাদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষণের পক্ষে সংসদে দাবি পেশ করেছিলেন।

কিন্তু এখনকার প্রজন্ম, এমনকি বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত নবীণ নেতা-কর্মীদের অনেকের কাছেই মহিলা বিলের এই আদি কাণ্ডারির লড়াই অনেকটাই অজানা। তাঁর একটি ভাল ছবি পর্যন্ত এখন স্থানীয় পার্টি অফিস বা দলীয় কর্মীদের কাছে পাওয়া দুষ্কর হয়। নিজের বাড়ি ও নিজের জেলার অনেক মহিলা জনপ্রতিনিধিও মহিলা সংরক্ষণ বিলের ক্ষেত্রে গীতার ভূমিকা সম্পর্কে স্পষ্ট ভাবে অবহিত নন।

যদিও গত বুধবার লোকসভায় মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হওয়ার পর বিজেপির নিশিকান্ত দুবে থেকে শুরু করে তৃণমূলের কাকলী ঘোষদস্তিদার—দলমত নির্বিশেষে একাধিক রাজনীতিক তাঁকে স্মরণ করেছেন।

প্রসঙ্গত, ১৯৯৬ সালেই এইচ ডি দেবগৌড়ার সরকার সংসদে মহিলা সংরক্ষণ বিল পেশ করে। সেই বিল পাঠানো হয় সংসদীয় যৌথ কমিটির কাছে। কমিটির চেয়ারপার্সন নিযুক্ত হন গীতা মুখোপাধ্যায়। শোনা যায়, মহিলা সংরক্ষণের লড়াইয়ের ব্যস্ত থাকবেন বলে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দেন গীতা।

কলকাতায় জন্ম হলেও বিবাহসূত্রে গীতা ছিলেন তমলুক শহরের বাসিন্দা। প্রয়াত সিপিআই নেতা তথা রাজ্যের প্রাক্তন সেচমন্ত্রী বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তাঁর। বিশ্বনাথের দাদা অজয় মুখোপাধ্যায় প্রবাদ প্রতিম স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী।

পাঁশকুড়ায় এলেই গীতা প্রয়াত সিপিআই সাংসদ চিত্তরঞ্জন দাসঠাকুরের বাড়িতে উঠতেন। চিত্তবাবুর স্ত্রী সবিতা গীতা মুখোপাধ্যায়কে রান্না করে খাওয়াতেন। মহিলা বিল নিয়ে সংসদ ভবনের সামনে আন্দোলনে গীতা মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীও ছিলেন সবিতা দাসঠাকুর। তিনি এ দিন বলেন, "আমার মনে আছে, গীতাদির সঙ্গে আমরা দিল্লিতে সংসদ ভবনের সামনে মহিলা বিল নিয়ে আন্দোলন করেছি। নিজেদের রক্ত দিয়ে লেখা চিঠি বিভিন্ন দফতরে আমরা পাঠিয়েছিলাম সে সময়। গীতাদি বেঁচে থাকলে খুব খুশি হতেন।"

তমলুক শহরে ১৯৫৬ সালে পুরসভার কাউন্সিলর (তৎকালীন কমিশনার) হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন গীতা। ১২ সদস্যের সেই পুরবোর্ডে তিনি একমাত্র মহিলা কাউন্সিলর ছিলেন। ১৮৬৪ সালে স্থাপিত তমলুক পুরসভার ইতিহাসেও প্রথম মহিলা কমিশনার ছিলেন তিনি।

মহিলাদের অধিকার রক্ষার আন্দোলনকে হাতিয়ার করেই তিনি পাঁশকুড়াবাসীর 'ঘরের মেয়ে' হয়ে উঠেছিলেন। স্বামী বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনীতির ময়দানে নামেন। নারী সুরক্ষা এবং সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব তিনি দিতেন তিনি।

বর্তমানে সিপিআইয়ের পূর্ব মেদিনীপুর জেলা সম্পাদক গৌতম পন্ডা দীর্ঘ একটা সময় গীতা মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ছিলেন এবং তাঁকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। তাঁর কথায়,"সব জায়গায় মহিলাদের নিয়ে কাজ করার ক্ষেত্রে বিশেষ আগ্রহী ছিলেন উনি। ওঁর আন্দোলন এত দিনে সার্থক হল। আমাদের গ্রামের বাড়ি পটাশপুরের পালপাড়া এলাকায়। আমার বাবা সুরপতি পন্ডা বিশ্বনাথ মুখোপাধ্যায়ের সহকারী ছিলেন। গীতাদেবী খুবই সাধারণ ভাবে থাকতেন। ছাত্রাবস্থা থেকেই দেখেছি, কৃষক-শ্রমিক ও খেতমজুরদের অধিকার আন্দোলনের পাশাপাশি মহিলা-পুরুষের সমান অধিকার নিয়ে বরাবর সোচ্চার হতেন। দলের মধ্যেও মহিলাদের নেতৃত্বে নিয়ে আসার চেষ্টা করতেন।’’

পশ্চিমবঙ্গে তখন যুক্তফ্রন্ট সরকার। রাজ্য জুড়ে চরম খাদ্য সঙ্কট। ১৯৬৮ সালে পাঁশকুড়ার আটবেড়িয়া গ্রামে একটি 'চাকি সেন্টার' স্থাপন করেন গীতা। পাঁশকুড়া এলাকার ৫০০ মহিলা সেখানে কাজে যুক্ত হন। এক-এক জন মহিলাকে দিনে ৪ কেজি গম দেওয়া হত। সেই গম পিষে এক-এক জন মহিলা আড়াই কেজি আটা পেতেন। বাকিটা জমা দিতে হত চাকি সেন্টারে।

১৯৮০ সালে পাঁশকুড়া লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হয়ে সাংসদ হন গীতা। পণপ্রথা রুখতে সেই সময় দলীয় বৈঠকে উপস্থিত ছেলের মা ও বাবাদের দিয়ে অঙ্গীকার করিয়ে নিতেন যে, তাঁরা কেউ ছেলের বিয়েতে পণ নেবেন না। বাড়ি-বাড়ি গিয়ে মহিলাদের নিয়ে এসে সাক্ষরতা কেন্দ্রে ভর্তি করতেন। তাঁর উদ্যোগে পাঁশকুড়া এলাকায় বহু 'সুলভ ক্যান্টিন' চালু হয়েছিল। সে গুলির পরিচালনার পুরোভাগে ছিলেন মহিলারাই।

গীতাদেবীর বাড়ির অদূরে মালাকার পাড়ায় থাকেন জয়দেব মালাকার। জয়দেব বলেন, ’’লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরতেন গীতাদি। কোনও গহনা পরতে দেখিনি। বাড়িতে এলে দাদা অজয় মুখোপাধ্যায় ভাই বিশ্বনাথকে ডেকে নিয়ে খেতে বসতেন। পরিবেশন করতেন গীতাদি। পারিবারিক ভাবে আমরা কংগ্রেসের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হলেও গীতা দলমত নির্বিশেষে পাড়ার সকলের খোঁজখবর নিতেন। আর রাজনৈতিক সভায় তাঁর বক্তব্য হাজার হাজার মানুষ মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতেন।’’

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Panskura CPIM

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy