বৃদ্ধাশ্রমে খবরের কাগজ পড়েন দু’একজন। তাঁরাই দেখেছেন, এসআইআর ফর্ম পূরণের জন্য বহু বছর পরে বাবা-মায়ের খোঁজ করছেন সন্তান। আশা জেগেছিল। ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সংশোধনের (এসআইআর) আবহে তাঁরাও ফিরতে পারবেন বাড়িতে। দেখতে পাবেন নাতি-নাতনির মুখ। সে আশা পূরণ হয়নি। এসআইআরের ফর্ম পূরণের ‘অছিলা’য় বাড়ি এসে পড়তে পারেন মা। কৌশলে তা আটকেছেন ছেলে মেয়েরা। পরিবার বিচ্ছিন্ন প্রবীণারা তা জেনে বিষাদে ডুবেছেন।
কাঁথি-১ ব্লকের ফরিদপুরে বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের অনেকের সঙ্গেই পরিবারের লোকজন তেমন যোগাযোগ রাখেন না। এনুমারেশনের ফর্ম পূরণের সুযোগেও কোনও যোগসূত্র তৈরি করতে দেননি। কেউ আশ্রম থেকে কিছু দূরে পরিচিতের দোকানে রেখে গিয়েছিলেন মায়ের ফর্ম। কেউ আগেভাগে বিএলও-র কাছে জমা দেন।
বৃদ্ধাশ্রম থেকে কিছুটা দূরেই বাড়ি বছর পঁয়ষট্টির অঞ্জলিরানি মাইতির। তাঁর কথায়, ‘‘কয়েকদিন ধরে পাশাপাশি লোকেদের কাছে শুনছি ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করা হচ্ছে। ভেবেছিলাম ছেলে হয়তো ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য বাড়ি ডেকে নিয়ে যাবে। নাতি-নাতনিকে দেখব। জানলাম ছেলে নাকি নিজেই ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়েছে।’’
কোলাঘাটে দর্জির কাজ করেছেন পুষ্পলতা মাজি। কষ্ট করে দুই মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করিয়েছেন। দু’জনেই চাকরি করেন। ঘটা করে বিয়েও দিয়েছেন। তবুও পুষ্পলতার ঠাঁই হয়েছে কাঁথির আশ্রমে। স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠে বলেন, ‘‘কয়েক বছর হয়ে গেল কেউ আর খোঁজ রাখে না। আশ্রমের লোকেরা যখন বলেছিল বাড়ির কাছে নিয়ে গিয়ে ফর্ম পূরণ করাবে তখন ভেবেছিলাম মেয়ে-জামাইয়ের সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু গিয়েও বাড়িঘর, পরিবার কাউকেই খুঁজে পেলাম না।’’
লকডাউনের সময় থেকে বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা হরিপ্রিয়া মল্লিক। বছর দুয়েক আগে একবার বাড়িতে গিয়েছিলেন। হরিপ্রিয়া বলছেন, ‘‘সে দিন রাতেই ছেলে আর বৌমা এমন অত্যাচার করল বাধ্য হয়ে আশ্রমে ফিরে আসি। এখন ভোটার তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার জন্য কিছুই বলেনি। যেই লোকজন বলেছে ফর্ম জমা না দিলে আমি নাকি বাড়ি পৌঁছে যেতে পারি। সেই ভয়ে তারা আগেভাগে আমার ফর্ম পূরণ করে জমা দিয়েছে।’’
আশ্রম কর্তৃপক্ষ সূত্রে খবর, এখানে মোট ২৫ জন বৃদ্ধা থাকেন। এঁদের দু’জনকে উদ্ধার করে রেখে গিয়েছিল কাঁথি থানার পুলিশ। ছ’জন ওই ঠিকানার বাসিন্দা। বাকিদের বাড়িঘর, পরিজন আছে। তাঁদের কয়েকজন বলেন, ‘‘পুজোর সময় বাড়িতে কত আনন্দ হত। অতিথিদের আগমন হত। সেই পুজোতেই ডাক পাই না। আশা ছিল হয়তো এবার বাড়ি যেতে পারব। এখন বুঝেছি আমাদের আর কোনও কাজেই লাগবে না।’’
বৃদ্ধাশ্রম পরিচালনার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তা ব্রজগোপাল সাহু বলেন, ‘‘সামাজিক আর মানবিক অবক্ষয় কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা বৃদ্ধাশ্রমের আবাসিকদের অতীত থেকেই উপলব্ধি করা যায়। মায়েরা ভেবেছিলেন হয়তো একবার বাড়ি গিয়ে কচিকাঁচাদের মুখ দেখবেন। কিন্তু সেই সুযোগটা তাঁরা পাননি। আমরা তাঁদের আনন্দে থাকার ব্যবস্থা করে থাকি। এলাকার অনেকে এসে তাঁদের সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগ করে যান।’’
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)