রূপনারায়ণে বিষ দিয়ে মারা মাছ ভেসে উঠেছে। নিজস্ব চিত্র।
পরিশ্রম নেই। ধৈর্যের পরীক্ষা দেওয়া বা সময় নষ্ট করারও দরকার পড়ছে না। নদ-নদীতে মেশানো হচ্ছে রাসায়নিক। এর বিষে মাছেরা ভেসে উঠছে দ্রুত। চলে আসছে পাড়ে। রাসায়নিক দিয়ে মারা মাছ দ্রুত ধরে তা বিভিন্ন বাজারে বিক্রি করছে দুষ্কৃতীরা। দুই জেলার নদ-নদীতে এমন ঘটনা ঘটছে বলে অভিযোগ। এতে নদীর জল দূষিত হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যের ক্ষতির আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে মৎস্যজীবীদের জীবিকায় টান পড়ছে। কিন্তু সব কিছু জেনেও প্রশাসন নীরব থাকায় সরব হয়েছেন মৎস্যজীবীরা।
কোলাঘাট ব্লকের অন্তর্গত ছাতিন্দা এবং পাইকবাড়ি এলাকায় রূপনারায়ণ নদে একদল দুষ্কৃতী বিষ প্রয়োগ করছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, রাসায়নিকের বিষে রাশি রাশি চিংড়ি মরে ভেসে উঠছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে মরা চিংড়ি ভেসে এসে ঠেকছে নদের ধারে। এ সব চিংড়ি ধরে কোলাঘাট, মেচেদা, তমলুকের পাশাপাশি প্রতিবেশী জেলা হাওড়ার বাগনানেও চড়া দরে দুষ্কৃতীরা বিক্রি করছে বলে অভিযোগ।
শুধু রূপনারায়ণ নয়, প্রতিবেশী পশ্চিম মেদিনীপুরের দাসপুরে খুকুড়দা সেতুর কাছেও কংসাবতী নদীর জলে বিষ প্রয়োগ করার অভিযোগ উঠেছে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে। সেখানেও একই কায়দায় দুষ্কৃতীরা চিংড়ি ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ। ওই দূষিত জল কাঁসাই থেকে গিয়ে মিশছে রূপনারায়ণে।
স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, গত ৮ নভেম্বর রূপনারায়ণ নদে বিষ দিয়ে মাছ ধরার সময় দুষ্কৃতীদের হাতে নাতে ধরে ফেলেন তাঁরা। কোনও রকমে দুষ্কৃতীরা পালিয়ে যায়। তবে দু’টি মোটর বাইক ফেলে গিয়েছিল তারা। স্থানীয়দের দাবি, মোটর বাইক দু’টি তাঁরা পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন। কোলাঘাটের বাসিন্দা তথা পেশায় মৎস্যজীবী ফটিককুমার মান্না বলছেন, ‘‘শুনেছি মেটাসিড জাতীয় রাসায়নিক নদীর জলে প্রয়োগ করা হচ্ছে। আগের তুলনায় ধীরে ধীরে চিংড়ি-সহ সবরকম মাছের পরিমাণও কমে গিয়েছে রূপনারায়ণে। একসময় নিয়মিত ৪-৫ কেজি চিংড়ি ধরতাম। এখন এক কেজি ধরা খুব মুশকিল।’’
গত কয়েক বছর ধরে রূপনারায়ণে বিষ দিয়ে মাছ ধরা এবং বিক্রির অভিযোগ মিলেছে। হলদিয়া শিল্পাঞ্চল এলাকা থেকে বিভিন্ন কারখানার রাসায়নিক মেশানো বর্জ্য-সহ ব্যাগও রূপনারায়ণের জলে পরিষ্কার করা হচ্ছে। এর ফলে কোলাঘাট ব্লকের সাহাপুর এলাকায় নদের জল দূষিত হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে মৎস্য দফতরের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট ব্লক প্রশাসন এবং পুলিশকে অবগত করা হয়েছে চলতি বছরের ২৪ মে। তার পর কোলাঘাট ব্লক প্রশাসনের উদ্যোগে মাইকে প্রচার করে বিষ দিয়ে মাছ ধরার বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। যদিও, তাতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি বলে অভিযোগ মৎস্যজীবীদের।
এ বিষয়ে পূর্ব মেদিনীপুর মৎস্যজীবী ফোরামের সভাপতি মানসী দাস বলছেন, ‘‘অবিলম্বে রূপনারায়ণ এবং কাঁসাই নদীতে বিষ দিয়ে মাছ ধরা বন্ধ করার জন্য সংশ্লিষ্ট থানায় লিখিত ভাবে অভিযোগ জানানো হয়েছে। তবে তারা কোনও পদক্ষেপ করেনি। তাই, জেলাশাসক এবং পুলিশ সুপারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছি।’’
ধ্বংসাত্মক উপায়ে মাছ ধরার ফলে মাছের পরিমাণ কমছে। তাতে উদ্বিগ্ন মৎস্যজীবীরাও। এ প্রসঙ্গে দক্ষিণবঙ্গ মৎস্যজীবী ফোরামের সভাপতি দেবাশিস শ্যামল বলছেন, "চিংড়ি এবং অন্য মাছের পরিমাণ অস্বাভাবিক ভাবে কমে গিয়েছে। রূপনারায়ণে ছোট ছোট নৌকোয় বা ছিপ দিয়ে বহু মৎস্যজীবী পরিবার মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন। অন্য বছরগুলোতে এই সময় প্রতি মাসে গড়ে এক থেকে দেড় কুইন্টাল চিংড়ি তাঁরা ধরতেন। এখন তার ছিটেফোঁটাও পান না। শুধু মাছ নয়, নদীর জল দূষিত হচ্ছে। নদীর বাস্তুতন্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অচিরে মানব স্বাস্থ্যের পক্ষে তা অত্যন্ত ক্ষতিকারক হতে পারে।’’
পরিবেশ দূষিত করে, মানুষের স্বাস্থ্যের কথা না ভেবে মাছ ধরার ধ্বংসাত্মক পদ্ধতির বিষয়টি মানছেন রাজ্যের মৎস্যমন্ত্রী বিপ্লব রায়চৌধুরী। তিনি বলছেন, "রূপনারায়ণ এবং কংসাবতী নদীতে বেশ কয়েকবার জলে বিষ মিশিয়ে মাছ ধরার অভিযোগ পেয়েছি। এটা অত্যন্ত মারাত্মক ঘটনা। বিডিও পুরো বিষয়টা দেখার আশ্বাস দিয়েছেন।’’ অভিযোগ প্রসঙ্গে পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার সৌম্যদীপ ভট্টাচার্য বলছেন, ‘‘এ ধরনের অভিযোগ আগে আসেনি। নদীতে বিষ প্রয়োগ করে মাছ ধরার অভিযোগ এলে পুলিশ নিশ্চিত ভাবে দুষ্কৃতীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy