রূপনারায়ণের তীরে কোনওমতে টিকে কাঠের ব্যবসা।
সময়ের সঙ্গে বদলেছে শহরের পরিচয়। একসময় রূপনারায়ণ ঘেঁষা কোলাঘাট ছিল অবিভক্ত মেদিনীপুরের অন্যতম প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র। বর্তমান শহরে চাল-কাঠের পাইকারি ব্যবসার রমরমা অতীত। আশির দশক থেকে একের পর এক চটকল বন্ধ হওয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে শহরের চিরাচরিত পাট ব্যবসাও। তবু পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রবেশদ্বার হিসেবে পরিচিত কোলাঘাট এখনও জেলার অন্যতম প্রধান ব্যবসার স্থান। পাইকারি ব্যবসা ছেড়ে কোলাঘাটের ব্যবসায়ীরা ঝুঁকছেন কাপড়, বৈদ্যুতিন পণ্যের খুচরো ব্যবসার দিকে।
রূপনায়ারণের তীরবর্তী প্রাচীন বন্দর ও বাণিজ্য নগরী তাম্রলিপ্তের মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে রূপনারায়ণের তীরে গড়ে উঠেছিল মেদিনীপুরের আরও এক বাণিজ্য কেন্দ্র। কাঠ, কয়লা, পাটের অন্যতম সেই বাণিজ্য কেন্দ্রকে ঘিরেই রূপনারায়ণ তীরবর্তী কোলা গ্রামের পাশে নদী তীরে গড়ে ওঠে একাধিক ঘাট। গবেষকরা জানাচ্ছেন, কোলা গ্রামের সেই ঘাটগুলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে আজকের কোলাঘাট। এই শহরের নামকরণ নিয়ে নানা জনশ্রুতি রয়েছে। কোলাঘাটের সংস্কৃতি গবেষক শ্যামল বেরার মতে, “নদীর তীরে বসবাসকারী জনজাতির কারও কারও পদবি ছিল কোলা। তা থেকেও ওই এলাকার নামকরণ হতে পারে বলে অনুমান। আবার রূপনারায়ণ নদীর কোল ঘেঁষে থাকার কারণে এই অঞ্চলের নামকরণ হয়ে থাকতে পারে।”
আগে কলকাতা থেকে কোলাঘাট পৌঁছতে জলপথ ও রেলপথই ছিল ভরসা। অবস্থানগত সুবিধার কারণে এখান থেকে ধান, চাল, খড়, কাঠ, কয়লা, পাট, টালি, ইট, গুড়, শাক-সব্জি প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানে রফতানি হত। পরবর্তীকালে হাওড়ার উলুবেড়িয়া থেকে কোলা গ্রামের উপর দিয়ে যাওয়া ওড়িশার পুরীর জগন্নাথ মন্দির পর্যন্ত ‘কটক রোড’ তৈরি হয়। ফলে কোলাঘাটের কাছে রূপনারায়ণের দু’দিকে সড়কের মধ্যে যোগাযোগ রাখতে ফেরি ঘাট চালু হয়। রেলপথ ও ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে ক্রমে জলপথের গুরুত্ব কমতে থাকে।
এক সময়, চালকলের পাশাপাশি কাঠ-কয়লা ও পাটের অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবেও খ্যাতি ছিল কোলাঘাটের। অবিভক্ত মেদিনীপুরের বিভিন্ন এলাকা থেকে জলপথে নৌকায় করে পাট নিয়ে আসা হত কোলাঘাটে। এখানে সেই পাট ছাঁটাই ও প্যাকিং করে রেলপথে ও সড়কে ট্রাকে করে হুগলি বিভিন্ন পাট কলে পাঠানো হত।
তবে সেই রমরমা এখন অতীত। কোলাঘাটের কাঠ, কয়লা ও পাটের ব্যবসা চলছে টিমটিম করে। কোলাঘাট কাঠচড়া ময়দানের পাশেই পারিবারিক সূত্রে তিন পুরুষ ধরে কাঠের ব্যবসা করা কৌশিক ভুঁইয়া বলেন, “১৯৫২ সাল থেকে আমাদের কাঠের ব্যবসা শুরু হয়েছিল। আগে উত্তরবঙ্গ, ওড়িশার জঙ্গল থেকে সরকারের থেকে নিলামে কাঠ কেনার পর তা রেলের ওয়াগনে ও জলপথে এখানে আনা হত। মূলত শাল, সেগুন, গামার কাঠ নিয়ে আসা হত।” তাঁর আক্ষেপ,“আগে এখানে মোট ২৭ জন কাঠের ব্যবসায়ী ছিলেন। সেই সংখ্যাটা এখন কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র তিনজনে। এখন হলদিয়া বন্দর দিয়ে আসা মালয়েশিয়ান কাঠের উপর ভর করে ব্যবসা কোনওমতে টিকে রয়েছে।”
এই ‘কোলা’ ঘাটেই ভিড়ত বাণিজ্যতরী।
ধুঁকছে কোলাঘাটের পাট শিল্পও। একসময় পাটের ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ছিল মূলত মাড়োয়ারি সম্প্রদায়ের ব্যবসায়ীদের হাতে। ক্রমে পাটকলগুলি বন্ধ হতে থাকায় ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারাতে থাকেন। একসময় যেখানে ৫০-৬০ জন পাট ব্যবসায়ী ছিল, এখন সেই সংখ্যাটা মাত্র দু’জন। তাঁদের মধ্যে এক জন আশকরন বেঙ্গানি বলেন, “প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যাগ চালুর ফলে চটকলগুলি বন্ধ হতে শুরু করে। আর তাতে পাটের ব্যবসা মার খেতে শুরু করে।”
বর্তমানে পাইকারি ব্যবসার স্থান নিয়েছে ছোটখাটো খুচরো ব্যবসা। মন্দার কারণে পাট ব্যবসা ছেড়ে কাপড়ের ব্যবসার দিকে ঝুঁকেছেন সুকেশ বাজাজ। তিনি বলেন, “কোলাঘাটে আমাদের পারিবারিক পাটের ব্যবসা ছিল। অনেক দিন আগেই সেই ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছি।” তাঁর বক্তব্য, “শহরের যোগাযোগ ব্যবস্থা এখনও দুর্বল। জশার সেতুর কাজও দ্রুত সম্পূর্ণ হওয়া দরকার। তাহলে আরও ক্রেতার সংখ্যা বাড়বে।”
ছবি: পার্থপ্রতিম দাস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy