E-Paper

পৃষ্ঠপোষক কই, টাকার চিন্তায় ঝুঁকি বাড়ে পর্বতারোহীদের

অভিযানের খরচ জোগাতে হিমশিম খান আরোহীরা। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আপস করতে হয় অভিযানের নানা দিকে, বাড়ে ঝুঁকি।

স্বাতী মল্লিক

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৫ ১০:০৫
পিয়ালির ভরসা ‘ক্রাউড ফান্ডিং’।

পিয়ালির ভরসা ‘ক্রাউড ফান্ডিং’। —ফাইল চিত্র।

পর্বতাভিযানে যেতে কেউ ঘাড়ে নিচ্ছেন লক্ষাধিক টাকার দেনা। কেউ বন্ধক রাখছেন আস্ত বসতবাড়ি! আবার কারও ভরসা ‘ক্রাউড ফান্ডিং’। কারণ, এভারেস্টই হোক বা অন্য আট হাজারি শৃঙ্গ, মাথা কুটেও পৃষ্ঠপোষক সংস্থার মন গলাতে পারেন না রাজ্যের বহু পর্বতারোহী। ক্রিকেট, ফুটবল বা অলিম্পিক্সের অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন খেলায় বহু সংস্থা টাকার ঝুলি নিয়ে প্রস্তুত থাকলেও ‘বঞ্চিত’ থেকে যায় পর্বতারোহণ। অভিযানের খরচ জোগাতে হিমশিম খান আরোহীরা। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আপস করতে হয় অভিযানের নানা দিকে, বাড়ে ঝুঁকি।

চলতি বছরে এ রাজ্য থেকে ফের এভারেস্টে (৮৮৪৮.৫ মিটার) যাচ্ছেন কৃষ্ণনগরের স্কুলশিক্ষিকা রুম্পা দাস। এর আগে ২০২১ সালে এভারেস্টে গেলেও কোভিডের কারণে ক্যাম্প ১ থেকে ফিরতে হয়েছিল তাঁকে। এ বার এভারেস্ট-স্বপ্ন পূরণের পথে কোনও পৃষ্ঠপোষকের খোঁজ পাননি। তাই বাড়ি বন্ধক রেখে ২৫ লক্ষ টাকা ঋণ নিয়েছেন রুম্পা ও তাঁর স্বামী। নেপাল থেকে রুম্পা বলছেন, ‘‘পর্বতারোহণের মতো অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস চোখের আড়ালে হয় বলেই হয়তো স্পনসরেরা আগ্রহী হন না। বার বার এভারেস্ট অভিযানের খরচও অনেক। তাই বাধ্য হয়ে বাড়ি বন্ধকের মতো বড় ঝুঁকি নিতে হল।’’

বাংলার পর্বতারোহী পিয়ালি বসাক কয়েক বছরে একাধিক আট হাজারি অভিযানে গেলেও কোনও সংস্থার সাহায্য মেলেনি। এভারেস্ট-জয়ের পরেও মেলেনি সরকারি সাহায্য। চন্দননগরের বাসিন্দা, প্রাথমিক স্কুলশিক্ষিকা পিয়ালি তবু ‘ক্রাউড ফান্ডিং’-এর জোরেই আরোহণ করেছেন এভারেস্ট, লোৎসে-সহ ছ’টি আট হাজারি শৃঙ্গে। তাঁর আক্ষেপ, ‘‘অভিযানের আগে অনুশীলনের বদলে লোকের দোরে দোরে ঘুরেছি। টাকা জোগাতে নাওয়া-খাওয়া-ঘুম ভুলে অসুস্থও হয়ে পড়েছি। মানসিক চাপ তো আছেই। পাহাড়ে যাওয়ার আগে সমতলের লড়াইটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে।’’

মা-বাবার মৃত্যুর পরে এ বার ফের আট হাজারির পরিকল্পনা করেছেন পিয়ালি। চিনের দিক থেকে চো ইউ এবং শিশাপাংমার কথা প্রথমে ভাবলেও পারমিট না মেলায় বিকল্প হিসাবে নেপালের দিক থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা (৮৫৮৬ মিটার) অভিযানে বেরিয়ে পড়েছেন। তবে একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের তরফে অভিযানের খরচের একাংশ দেওয়ার আশ্বাস মিলেছে। বাকি খরচের জন্য পিয়ালির ভরসা সেই ‘ক্রাউড ফান্ডিং’।

পর্বতারোহী মহলের মতে, এই সব অভিযানে খরচের বহর এতটাই যে, কোনও পৃষ্ঠপোষক না জুটলে বা টাকার ব্যবস্থা না হলে সেই পাহাড়প্রমাণ চাপ ঘাড়ে চেপে বসে। সস্তায় অভিযান সারতে গিয়ে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, সরঞ্জাম, জামাকাপড়, খাওয়াদাওয়া, অভিজ্ঞ আয়োজক সংস্থা, ভাল দল, অভিযানের দিনক্ষণ— সব দিকেই আপস করতে হয়। সস্তার আয়োজক সংস্থার সঙ্গে অভিযানে যাওয়ার খেসারতও দিতে হয় অনেককে।

পিয়ালির কথায়, ‘‘পুরো টাকা দিতে না পারায় অনেক সময় পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার আমায় দেওয়া হয়নি। স্যাটেলাইট ফোনের পয়সা না থাকায় বিপদে পড়লে যোগাযোগের সুযোগ থাকে না। এ ছাড়া, মানসিক ভাবে হয়রানি তো আছেই। এভারেস্টের সময়ে প্রথমে পুরো টাকা দিতে পারিনি বলে ভাল আবহাওয়ার দিনেও ক্যাম্পে বসে ছিলাম। পরে তুষারঝড়ের মধ্যে যখন সবাই নেমে আসছে, তখন বিপদ মাথায় নিয়ে ‘সামিট’-এর দিকে এগিয়েছিলাম।’’

২০১৫ ও ২০১৬ সালে এ রাজ্য থেকে এভারেস্ট অভিযানে যাওয়া সত্যরূপ সিদ্ধান্তও জানালেন, পর্যাপ্ত টাকার অভাবে এভারেস্টে গিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডারের ব্যাপারে আপস করতে দেখেছিলেন লোকজনকে। তার ফল হয়েছিল মারাত্মক।
সত্যরূপ ও তাঁর সঙ্গীরাও টাকার অভাবে দামি ডাংরি-জুতোর বদলে স্থানীয় ডাংরি ও জুতো কিনে কাজ চালিয়েছিলেন।

ঠাকুরপুকুরের বাসিন্দা সত্যরূপের সপ্তশৃঙ্গ ও সপ্ত আগ্নেয়গিরি অভিযানের সময়ে যদিও কিছু সংস্থা আর্থিক সাহায্য করেছিল। তবে তা ছিল ওই বিপুল খরচের কিয়দংশ মাত্র। ফলে ‘ক্রাউড ফান্ডিং’ করার পরেও লক্ষাধিক টাকা ঋণ নিতে হয়। ‘‘পর্বতারোহণে স্পনসর জোটানো কঠিন হলেও একেবারে অসম্ভব নয়। ভাল পর্বতারোহী হিসাবে পরিচিতি পেলে সংস্থারা পৃষ্ঠপোষকতায় আগ্রহ দেখাতে পারে। কোনও সংস্থার কাছে আরোহীর দেওয়া প্রস্তাব যদি ঠিকঠাক থাকে, তা হলে কিন্তু সাহায্য মিলতেও পারে,’’ —বলছেন সত্যরূপ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Mountaineering Piyali Basak

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy