রাজ্য সড়ক থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ভুট্টা আর গম খেতে ঘেরা তিন তলা স্কুলবাড়ি। লস্করপুর হাইস্কুল। ওই তল্লাটের শতকরা ৯০ ভাগ পরিবারের পুরুষেরা পেশায় রাজমিস্ত্রি আর মহিলারা বিড়ি বাঁধেন। গরিব পরিবারের খুদেরা মিড ডে মিলের টানে প্রাথমিক স্কুলে যায় বটে। কিন্তু চতুর্থ শ্রেণির গণ্ডি পার করে বহু পড়ুয়া হাই স্কুলের পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হয় বর্ণপরিচয়ের জ্ঞান ছাড়াই। তারা নামতা, যোগ-বিয়োগ কিংবা এবিসিডি জানে না।
পাশফেল প্রথা না থাকায় তারা কিছু না শিখেই চার বছর পর নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। তার পর অবধারিত ফেল এবং স্কুলছুট। ছেলেরা কেউ কাজে লেগে পড়ে। আর মেয়েদের বিয়ে। নিজেরা তেমন লেখাপড়া না জানায় অভিভাবকেরাও এই ব্যবস্থাকে ভবিতব্য বলে ধরে নিয়েছিলেন। এই ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে জোটবদ্ধ হয়েছেন লালগোলার লস্করপুর হাই স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা।
বাংলা-ইংরেজি লিখতে ও পড়তে, যোগ-বিয়োগ, গুন-ভাগ করতে পারার মতো সক্ষম করে তুলতে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের নামতা, এবিসিডি শেখানোর পাশাপাশি বর্ণপরিচয় করাচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষিকারা। মঙ্গলবার বিগত চার বছরের পাঠ দেওয়ার উপযোগী তিনটি বইও প্রকাশ করল লস্করপুর হাইস্কুল। ওই বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) পূরবী দে বিশ্বাস বলেন, ‘‘এটা অসাধারণ ও অনুসরণযোগ্য উদ্যোগ।’’এ দিন বই প্রকাশ ছাড়াও একটি ডিজিটাল ক্লাসরুমেরও উদ্বোধন করা হয়।
ওই উদ্যোগের শুরু অবশ্য বছর তিনেক আগে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে। পঞ্চম শ্রেণিতে প্রতি বছর ওই স্কুলে শ’পাঁচেক ছেলেমেয়ে ভর্তি হয়। প্রধানশিক্ষক জাহাঙ্গির আলম বলেন, ‘‘বেশিরভাগ পড়ুয়ার বর্ণপরিচয়টুকুও নেই। ফলে তারা পঞ্চম শ্রেণির বাংলা, অঙ্ক, ইংরাজিতে দাঁত ফোটাতে পারে না।’’ তিনি জানান, এ ভাবে কোনও কিছু না জেনেই তারা নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে যায়। তারপর দশম শ্রেণি ওঠার সময় অনুত্তীর্ণ হয়ে তারা স্কুল ছেড়ে দেয়। বছরের পর বছর ধরে এই পুনরাবৃত্তি রুখতে পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের শিক্ষাগত অবস্থান অনুসারে তিনটি ভাগে ভাগ করে তাদের নামতা, পড়া ও লেখা শেখানো শুরু হয়। তারপর সড়গড় হলে সিলেবাস অনুসারে তাদের পঞ্চম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তক পড়ানো হয়।
ওই পদ্ধতিতে বেশ কিছুটা সুফল মিললেও পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত ৪টি ক্লাসের বাংলা, অঙ্ক ও ইংরাজি মিলে মোট ১২টি বই পড়ানো বেশ দুরূহ ব্যাপার। প্রধানশিক্ষক বলেন, ‘‘এ কারণে নিজেদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্কের মোট তিনটি বই আমরা লিখেছি। ওই তিনটি বই পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের পড়ানোর পরে তাদের নিজেদের সিলেবাসের পড়া শুরু করানো হয়।’’
জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক (মাধ্যমিক) পূরবী দে বিশ্বাস বলেন, ‘‘প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে হাই স্কুলে আসার সময় পড়ুয়ারা পঞ্চম শ্রেণির উপযুক্ত হয়ে আসে না। লস্করপুর হাইস্কুলের শিক্ষকরা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছেন। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে পিছিয়ে পড়া পড়ুয়াদের জন্য তিনটি বই প্রকাশ করে তাঁরা দৃষ্টান্ত গড়লেন। তাঁদের এই সাফল্য অন্য স্কুলেও ছড়িয়ে পড়ুক।’’