Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

আজ ছেলের অপারেশন হবে ভাবিনি

এর আগে গত সপ্তাহে কয়েক দিন টানা আউটডোর বন্ধ রেখে আন্দোলন চালিয়েছিলেন জেএনএমের জুনিয়ার ডাক্তারেরা।

রবিবার এরকমই খোলা ছিল কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। সোমবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। —ফাইল চিত্র

রবিবার এরকমই খোলা ছিল কল্যাণী জেএনএম হাসপাতালের জরুরি বিভাগ। সোমবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। —ফাইল চিত্র

সৌমিত্র সিকদার
কল্যাণী শেষ আপডেট: ১৮ জুন ২০১৯ ০০:১৭
Share: Save:

আন্দোলনের প্রাবল্য থাকলেও শেষ পর্যন্ত সেবা আর মানবধর্মের তুলনায় তাকে অগ্রাধিকার দিতে পারলেন না কল্যাণী জওহরলাল নেহরু মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসকেরা।

এনআরএস কাণ্ডের জেরে সোমবার দেশব্যাপী সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালের আউটডোর বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন চিকিৎসকেরা। আন্দোলনে শামিল থাকলেও জেএনএমের চিকিৎসকেরা এ দিন রোগীদের বিপদে ফেলে আউটডোর পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ রাখতে পারেননি। ইমার্জেন্সি বা জরুরি বিভাগের একটু দূরে সোমবার একটি ঘরে অস্থায়ী আউটডোর খোলা হয়েছিল। হাসপাতালে বেশ কয়েক জন সিনিয়র চিকিৎসক সেখানে রোগী দেখছেন।

এর আগে গত সপ্তাহে কয়েক দিন টানা আউটডোর বন্ধ রেখে আন্দোলন চালিয়েছিলেন জেএনএমের জুনিয়ার ডাক্তারেরা। তাতে দুরবস্থার একশেষ হয়েছিল রোগী ও তাঁদের পরিজনের। ক্ষিপ্ত রোগীপক্ষের সঙ্গে দফায়-দফায় আন্দোলনরত চিকিৎসকদের তর্কাতর্কি, হাতাহাতিও হয়েছে। হস্টেল খালি করে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন অধিকাংশ জুনিয়র ডাক্তার। নতুন করে রোগী ভর্তি কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চিকিৎসকের অভাবে ভর্তি থাকা রোগীদেরও ছেড়ে দেওয়া হচ্ছিল।

হাসপাতালের পরিষেবা যখন এই ভাবে তলানিতে এসে ঠেকেছে সেই পরিস্থিতিতে নিজেদের অনড় অবস্থান ছেড়ে চিকিৎসকেরা অস্থায়ী আউটডোরে সোমবার পরিষেবা দেওয়ায় বহু রোগী এ দিন স্বস্তি পেয়েছেন। তাঁদের অনেকেই এ দিন চিকিৎসকদের ভূমিকার প্রশংসাও করেন।

বছর তেইশের বাসবকে বর্ধমানের কাটোয়া থেকে নিয়ে এসেছিলেন আত্মীয়েরা। তাঁকে শুধু হাসপাতালে ভর্তি করাই নয়, কিছু ক্ষণের মধ্যে তাঁর অস্ত্রোপচারও করা হয়। বাসবের মা কৃষ্ণা হালদার আপ্লুত গলায় বলেন, “আমার তো বিশ্বাস হচ্ছে না ডাক্তারবাবুরা এই অবস্থায় আমার ছেলেকে অপারেশন করে বাঁচালেন! ছেলেকে তো হাসপাতালে নিয়ে আসতেই ভয় পাচ্ছিলাম। বুঝতেই পারছিলাম না ওঁকে ডাক্তারবাবুরা দেখবেন কিনা, এখন দেখছি এখানে নিয়ে এসে ঠিক করেছি। গত রাত থেকে ওর অসহ্য পেটের যন্ত্রণা হচ্ছিল। বাড়িতে রাখা যাচ্ছিল না। শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, যাই হোক হাসপাতালে এক বার নিয়ে যাই। এখন মনে হচ্ছে, এক দম ঠিক করেছিলাম। অন্য কোথাও নিয়ে গেলে জানি না কী বিপদ হত।”

এদিন সকাল থেকে হাসপাতালে জরুরি বিভাগে কোনও রোগী এলেই চিকিৎসকেরা তাঁকে পরীক্ষা করে দেখছিলেন। যে সব রোগীকে আউটডোরে দেখে ওষুধ দিয়ে ছেড়ে দেওয়া উচিত বলে তাঁরা মনে করেছেন তাঁদের জরুরি বিভাগ থেকেই অস্থায়ী আউটডোরে পাঠানো হয়েছে। উত্তর ২৪ পরগনার নৈহাটির বাসিন্দা মুকেশ কুমার সাউ যেমন বললেন,‘‘ হাতে খুব ব্যথা করছিল। আমার এক বন্ধু বলল, ‘চল হাসপাতালে, দেখি কী হয়।’ গেটের কাছে আসতেই এক জন বলল আউটডোর খোলা আছে। হাতে চাঁদ পেলাম। এখন ডাক্তার দেখিয়ে বাড়ি ফিরছি। চিকিৎসকেরা যে এইটুকু মানবিকতা দেখিয়েছেন তাতে খুব ভাল লাগছে।”

আউটডোরে গিয়ে দেখা গেল, কৌস্তব চক্রবর্তী, অনিশ খাঁ, দেবাশিস মণ্ডল, নয়ন সরকার সহ- বেশ কয়েক জন রোগী দেখেছেন। দিনের শেষে প্রায় ২০০ রোগী তাঁরা দেখেন। চিকিৎসক সুবিকাশ বিশ্বাস বলেন, “আমরা পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছিলাম। কিন্তু, তা গৃহীত হয়নি। রোগী দেখার কর্তব্য এড়াতে পারিনি।“ পাশের টেবিলে বসে চিকিৎসক অনিশ খাঁ বলেন, “অন্য দিন আমি একাই আউটডোরে প্রায় ২০০ রোগী দেখি। সেই হিসাবে এ দিন রোগী অনেক কম এসেছেন।’’ হাসপাতাল সূত্রের খবর, অন্য দিন আউটডোরে প্রায় আটশো রোগী হয়। সোমবার তুলনায় ভিড় কম ছিল। হাসপাতালের সুপার অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “মানবিকতার কথা ভেবে এ দিন আউটডোর পরিষেবা চালু রাখা হয়। এ দিন রোগী ভর্তিও করা হয়েছে। ২ জন রোগীর অস্ত্রোপচারও হয়েছে।”

নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনায় এ দিন জেএনএমের দু’জন জুনিয়র ডাক্তারও অংশ নেন। পরে তাঁরা জানান, মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একাধিক দাবি তুলে ধরা হয়েছে। যেমন, জেলার মেডিক্যাল কলেজ ও ডেন্টাল কলেজগুলির পরিকাঠামোগত সমস্যা নিয়ে সাত দিনের মধ্যে ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ আধিকারিকদের বৈঠক করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর কোনও আঘাত নেমে এলে প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে সঙ্গে-সঙ্গে এফআইআর করতে হবে। আহত চিকিৎসককে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। আঘাতের কারণে সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক আর কোনও দিন কাজ করতে না-পারলে সারা জীবন তাঁর ভরনপোষণের দায়িত্ব দিতে হবে সরকারকে। স্বাস্থ্যকর্মীদের উপর আক্রমণ হলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অভিযুক্তদের জামিন অযোগ্য ধারায় গ্রেফতার করতে হবে। বিচারের কাজ চালাতে হবে ফাস্ট ট্রাক কোর্টে। রোগীর আত্মীয়দের দঙ্গল বেঁধে ইমার্জেন্সি ও ইন্ডোরে ঢুকে পড়ার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। রোগীর পরিজনদের যথাযথ পরিচয়পত্র জমা দিয়ে ভিতরে ঢুকতে হবে। হাসপাতালের কোনও সম্পত্তির ক্ষতি হলে যাঁরা ভাঙচুর চালাবে তাঁদেরই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kalyani JNM Hospital Bengal Doctors Strike
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE