Advertisement
১৫ মে ২০২৪
Cyclone Amphan

শাসক-বিরোধী মাসতুতো ভাই?

ঘূর্ণীঝড় ধসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল বহু জনের ঘর। তাঁদের ত্রাণের টাকা পাইয়ে দেওয়ার বদলে আত্মীয়-পরিজনের নামে লুটতে নেমেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা। ক্ষোভের আঁচ পৌঁছেছে নবান্ন পর্যন্ত। এখন শুরু হয়েছে টাকা ফেরত দেওয়ার পালা। কিন্তু সত্যিই কি সরকারের ঘরে সব টাকা ফিরবে, ত্রাণ পৌঁছবে প্রকৃত প্রাপকদের হাতে? অন্তর্তদন্তে নামল আনন্দবাজার।ঘূর্ণীঝড় ধসিয়ে দিয়ে গিয়েছিল বহু জনের ঘর। তাঁদের ত্রাণের টাকা পাইয়ে দেওয়ার বদলে আত্মীয়-পরিজনের নামে লুটতে নেমেছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতানেত্রীরা। ক্ষোভের আঁচ পৌঁছেছে নবান্ন পর্যন্ত। এখন শুরু হয়েছে টাকা ফেরত দেওয়ার পালা। কিন্তু সত্যিই কি সরকারের ঘরে সব টাকা ফিরবে, ত্রাণ পৌঁছবে প্রকৃত প্রাপকদের হাতে? অন্তর্তদন্তে নামল আনন্দবাজার।

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

নিজস্ব প্রতিবেদন
নদিয়া শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২০ ০৬:৫৩
Share: Save:

তৃণমূল হোক বা বিজেপি, যে যেখানে ক্ষমতায় আছে সেখানেই ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরিতে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। প্রকৃত ক্ষতিগ্রস্তদের বঞ্চিত করে নেতানেত্রীদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ক্ষতিপূরণের টাকা বিলি করা হয়েছে। এই দুর্নীতি জল বেশি দূর গড়ালে আগামী বিধানসভা ভোটের আগে তা ক্ষমতাসীন দলগুলির পক্ষে বিড়ম্বনার হয়ে উঠতে পারে। সম্ভবত সে কথা মাথায় রেখেই শাসক দলের নেতাদের নিজের দলের জনপ্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে হচ্ছে। একাধিক পঞ্চায়েত প্রধানকে শো-কজ় পর্যন্ত করতে হয়েছে। আবার বিজেপির রাজ্য সভাপতিকে প্রকাশ্যে দলের অভিযুক্ত পঞ্চায়েত প্রধানের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপ করার কথাও বলতে হচ্ছে।

কিন্তু আমপান ত্রাণ নিয়ে লাগামহীন স্বজনপোষণ বঞ্চিত ক্ষতিগ্রস্তদের মুখে-মুখে ফিরিয়ে এনেছে একটা চেনা কথা— ‘চোরে চোরে মাসতুতো ভাই!’ কেননা স্বজনপোষণের তালিকায় সই রয়েছে শাসক আর বিরোধী দুই দলের লোকেদেরই।

জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, আমপানের ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরির জন্য পঞ্চায়েত স্তরে চার জনের একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। কারা ক্ষতিপূরণ পাওয়ার যোগ্য সেই তালিকা তৈরি করে ওই কমিটিই ব্লক অফিসে পাঠিয়েছে। চার জনের কমিটিতে ছিলেন পঞ্চায়েত প্রধানের প্রতিনিধি হিসাবে স্থানীয় পঞ্চায়েত সদস্য, পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতির প্রতিনিধি হিসাবে সমিতির স্থানীয় সদস্য, পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা এবং বিডিও-র প্রতিনিধি হিসেবে পঞ্চায়েত সচিব। কোথাও সচিবের পদ খালি থাকলে জব অ্যাসিস্ট্যান্ট ছিলেন। প্রধান বা সভাপতি প্রতিনিধি পাঠিয়ে না থাকলে বিডিও তাঁর প্রতিনিধি দিয়েছেন। তালিকায় সই রয়েছে চার জনেরই।

আর এখানেই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে প্রায় সর্বত্র বিরোধী দলের ভূমিকা নিয়ে। প্রশ্ন উঠছে: প্রধান, উপপ্রধান বা ক্ষমতায় থাকা শাসক দলের সদস্যদের পরিবারের সদস্য বা নিকট আত্মীয়স্বজনের নাম যদি তালিকায় থেকে থাকে, তা হলে বিরোধী দলনেতা কেন আপত্তি জানালেন না? কেন সেই তালিকায় সই করলেন পঞ্চায়েত সচিব বা জব অ্যাসিস্ট্যান্ট? যেখানে তৃণমূলের প্রধান রয়েছেন সেখানে বিজেপির বিরোধী দলনেতা, আবার যেখানে বিজেপির প্রধান সেখানে তৃণমূলের বিরোধী দলনেতা কেন আপত্তি না জানিয়ে সই করলেন? তা হলে কি আসলে দুর্নীতির প্রশ্নে সব দলের নেতা-জনপ্রতিনিধিরা তলায়-তলায় হাত মিলিয়েছেন?

অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধী দলনেতারা দাবি করছেন, তাঁদের নাকি জানানোই হয়নি। তাদের কোন তালিকাতেই সই করানো হয়নি। তা হলে সে ক্ষেত্রে তাঁরা কেন প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেন না? বেথুয়াডহরি ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের বিরোধী দলনেতা পুলক সিংহ যেমন বিডিও-র কাছে লিখিত অভিযোগ জানিছেন। তাঁর দাবি, “ফর্মে আমায় সই করানো হয়নি।” সত্য-মিথ্যা পরের কথা, কিন্তু এমন অভিযোগও যে বিশেষ জমা পড়েনি! বরং প্রায় সর্বত্রই দেখা গিয়েছে বিরোধী দলনেতারা অশ্চর্যজনক ভাবে নীরব। সে বিজেপির লোক হোক বা তৃণমূল কিংবা সিপিএম। রাজনৈতিক দলগুলিকে আমপানের ক্ষতিপূরণ নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে রাস্তায় নামতে দেখা গেলেও আসল জায়গায় কার কী ভূমিকা ছিল, তা আদৌ স্পষ্ট নয়।

‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে নেমে কী বলছেন নেতারা?

বিজেপির নদিয়া উত্তর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি আশুতোষ পালের দাবি, “আমরা খবর নিয়ে দেখেছি, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আমাদের বিরোধী দলনেতাদের ভুল বুঝিয়ে সই করিয়ে নেওয়া হয়েছে।” সিপিএমের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুমিত বিশ্বাসও দাবি করেন, “যে ক’টা গ্রাম পঞ্চায়েতে আমাদের বিরোধী দলনেতা আছেন, তাঁদের কিছু না জানিয়েই এই তালিকা তৈরি করা হয়েছে। আমাদের বিরোধী দলনেতারা লিখিত ভাবে বিডিও-দের কাছে অভিযোগ করেছেন।” তাঁর মতে, “আসলে বিজেপি আর তৃণমূল যৌথ ভাবে এই দুর্নীতি করেছে।” তৃণমূলের কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলার সহ-সভাপতি নাসিরুদ্দিন আহমেদ আবার ব্যাখ্যা এড়িয়ে গিয়ে বলেন, “বিষয়টি নিয়ে আমরা সাংগঠনিক স্তরে আলোচনা করব।”

তবে ভাগ-যোগ করে ত্রাণের টাকা আত্মসাৎ করার এই ষড়যন্ত্র যে আগামী বিধানসভা ভোটে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে, সেই আন্দাজ রয়েছে সব দলের নেতাদেরই। তাই অন্তত মুখে শাস্তিমূলক পদক্ষেপের কথা বলতে হচ্ছে। দিন দুয়েক আগে কৃষ্ণনগর দক্ষিণের তৃণমূল বিধায়ক তথা কারামন্ত্রী উজ্জ্বল বিশ্বাস দলের জন প্রতিনিধিদের টাকা ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। দলের রানাঘাট সাংগঠনিক জেলার সভাপতি শঙ্কর সিংহ শো-কজ় করেছেন গাজনা ও শিলিন্দা ১ গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধানদের। কৃষ্ণনগরে এসে অভিযুক্ত প্রধান-উপপ্রধানদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক পদক্ষেপের কথা বলতে হয়েছে বিজেপির দিলীপ ঘোষকেও। শেষরক্ষা হবে কি না তা অবশ্য অনেকটাই নির্ভর করছে আত্মসাৎ হওয়া টাকা কতটা সরকারের ঘরে ফেরে, যোগ্য প্রাপকদের ক্ষোভ কতটা প্রশমিত হয়, তার উপরে।

কিন্তু নেতারা যতই তর্জনগর্জন করুন, বেহাতে চলে যাওয়া টাকা শেষমেশ কতটাই বা ফিরবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cyclone Amphan TMC BJP
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE