Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

মানসিক হাসপাতাল, না কি লোক হাসানো?

সার দেওয়া বিছানায় সবুজ চাদর পাতা ‘ওয়ার্ড’। সেখানও বিচিত্র সব কীর্তিকলাপ। তন্বী কিশোরী সেলফি তুলছে খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে। উৎসাহী তরুণ ভিডিয়ো তুলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেসবুকে লাইক আর শেয়ারের বন্যা। কিছু কটু-কড়া সমালোচনাও যে ধেয়ে আসছে না, তা নয়। কিন্তু তাতে কী আসে-যায়?

কালীপুজোর এমন থিমে দানা বেঁধেছে বির্তক। ধুবুলিয়ায়। নিজস্ব চিত্র

কালীপুজোর এমন থিমে দানা বেঁধেছে বির্তক। ধুবুলিয়ায়। নিজস্ব চিত্র

সুস্মিত হালদার 
ধুবুলিয় শেষ আপডেট: ৩১ অক্টোবর ২০১৯ ০২:৫৫
Share: Save:

গারাদ দেওয়া খাঁচায় একের পর এক নানা কিসিমের মুখে রং মাখা, ছেঁড়া জামা, শিকল পরানো পুরুষ-নারী বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছে। তেড়ে যাচ্ছে, খ্যা-খ্যা করে হাসছে।

আর তা দেখে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে জনতা। ছোটরা যদি বা চমকে ওঠে, বড়রা বুঝিয়ে দিচ্ছে, ‘আরে, ওটা তো পাগল!’ ফোকলা মুখে ছড়িয়ে পড়ছে হাসি— পাগল! পাগল!

সার দেওয়া বিছানায় সবুজ চাদর পাতা ‘ওয়ার্ড’। সেখানও বিচিত্র সব কীর্তিকলাপ। তন্বী কিশোরী সেলফি তুলছে খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে। উৎসাহী তরুণ ভিডিয়ো তুলে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। ফেসবুকে লাইক আর শেয়ারের বন্যা। কিছু কটু-কড়া সমালোচনাও যে ধেয়ে আসছে না, তা নয়। কিন্তু তাতে কী আসে-যায়?

নদিয়ার ধুবুলিয়ায় কালীপুজোর মণ্ডপে এই ‘মানসিক হাসপাতাল’ হইচই ফেলে দিয়েছে চারদিকে। বিতর্ক গমগম করছে ফেসবুকে। প্রশ্ন উঠছে: মানসিক হাসপাতাল সম্পর্কে ন্যূনতম জ্ঞান এবং মনোরোগীদের সম্পর্কে সামান্য সহমর্মিতা থাকলে কি এই কাণ্ড ঘটানো যায়?

ঘটনাচক্রে, গোটা বিষয়টি যাঁর মস্তিষ্কপ্রসূত, ধুবুলিয়ার ১২ নম্বর গ্রুপের যুবকবৃন্দ ক্লাবের সম্পাদক সাধন হালদারের স্ত্রী এক সময়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছিলেন। বাড়িতে আটকে রাখতে হত তাঁকে। কোনও ফাঁকে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লে নানা লাঞ্ছনার মুখে পড়তেন। এক সময়ে তাঁকে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরে মানসিক হাসপাতালে ভর্তিও করাতে হয়েছিল। দু’বছর পরে কিছুটা সুস্থ হয়ে ফিরলেও তার পরে আর বেশি দিন বাঁচেননি তিনি।

সাধনের দাবি, সেই সময়ে তিনি খুব কাছ থেকে দেখেছেন কী ভাবে সমাজ মানসিক রোগীদের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে। মানসিক হাসপাতালের ছবিটাই বা কেমন। তাঁর কথায়, “জীবন দিয়ে বুঝেছি বলেই চেয়েছিলাম এমন থিম করতে যাতে মানসিক রোগীদের যন্ত্রণা দেখে মানুষ তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়।” তাঁর ছেলে বিভাস হালদার ক্লাবটির কোষাধ্যক্ষ। তিনিও বলেন, “মা যখন হাসপাতালে ছিল, দেখতে যেতাম। পরিবেশ দেখে খুব কষ্ট হত। সেটাই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।’’

সত্যিই যদি মনোরোগীদের যন্ত্রণা বা মানসিক হাসপাতালের দুরবস্থা তুলে ধরে আমজনতাকে সচেতন করা তাঁদের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, তা প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু সেই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে কী?

শক্তিনগর জেলা হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ সুব্রত বিশ্বাসের মতে, ‘‘মনে হয় ওঁরা মানসিক হাসপাতাল সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ। তাই এমন অতিরঞ্জিত করেছেন। এ সব দেখে মানুষ তো আরও মানসিক হাসপাতাল থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেবে!’’ মনোরোগীদের অধিকার আন্দোলনের কর্মী রত্নাবলী রায় বলেন, ‘‘মানসিক হাসপাতাল থিম করে পুজোমণ্ডপ চমৎকার উদ্যোগ। কিন্তু যা দেখানো হয়েছে তা বাস্তব থেকে বহু দূরে।’’

ধুবুলিয়ার এই দরিদ্র উদ্বাস্তু কলোনিতে ৬৪ বছর ধরে পুজো করে আসছে যুবকবৃন্দ ক্লাব। আগে তেমন বড় করে পুজো হত না। বছর পাঁচেক আগে অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্ম দায়িত্ব নেওয়া ইস্তক পুজো জমজমাট হয়েছে। এখন প্রতি বছর একটা ‘থিম’ বেছে নেওয়া হয়। কালীনারায়ণপুরের এক পেশাদার সংস্থার ১৯ জন কেউ মানসিক রোগী সেজেছেন তো কেউ চিকিৎসক বা নার্স। গত সোমবার থেকে আজ, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চার দিনের জন্য ৬০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়েছে। চিকিৎসক সাজা সুজিত সরকার বলেন, “আমরা পেশাদার। যে যেমন ‘থিম’ বলে, ফুটিয়ে তুলি। এর বেশি আমরা কিছু জানি না।”

ধুবুলিয়ায় বেশ কয়েকটি বড় কালীপুজো হয়। এ বার সবাইকে টেক্কা দিয়ে যুবকবৃন্দের মণ্ডপ ব্যাপক লোক টেনেছে। সন্ধের পর থেকেই লম্বা লাইন। সেই ভিড় কি মনোরোগীদের প্রতি সচেতনতার টানেই?

মিহির কর্মকার নামে এক দর্শক বলেন, “বিষয়টা তো মজার। আমার ছেলে খুব খুশি। এ সব অঙ্গভঙ্গি দেখে বাচ্চারা তো মজা পাবেই!” ধুবুলিয়ারই সঞ্জয় সরকার আবার বলেন, ‘‘আমিও দেখতে গিয়েছিলাম। খুব বাড়াবাড়ি। মনোরোগীরা যেন হাসির খোরাক!”

সাধন অবশ্য এখনও অনড়— ‘‘কে কী ভাবে নিচ্ছেন, জানি না। কিন্তু আমরা আমাদের মতো চেষ্টা করেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Kalipuja Kali Puja 2019 Kali Puja Theme Asylum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE