Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

জল নামছে, বাড়ি ফিরছেন দুর্গতেরা

নদিয়ার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলে আশ্বস্ত করল জেলা সেচ দফতর। ভাগীরথী, জলঙ্গি ও চূর্ণির জলস্তর ধীরে ধীরে কমছে। ফলে সব এলাকা থেকেই বন্যার জল কমবেশি সরতে শুরু করেছে। বাড়িও ফিরছেন কেউ কেউ। তবে ভাগীরথী এবং জলঙ্গির জলস্তর নামলেও এখনও তা চরম বিপদসীমার উপর দিয়েই বইছে। নবদ্বীপ-সহ জেলার বড় একটি অংশের বন্যা নির্ভর করে পার্শ্ববর্তী কাটোয়ার ভাগীরথী এবং অজয়ের উপর।

ছাদে তাঁবু খাটিয়ে চলছে বসবাস। নবদ্বীপের খেজুরবাগানে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

ছাদে তাঁবু খাটিয়ে চলছে বসবাস। নবদ্বীপের খেজুরবাগানে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১১ অগস্ট ২০১৫ ০২:০২
Share: Save:

নদিয়ার বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল বলে আশ্বস্ত করল জেলা সেচ দফতর। ভাগীরথী, জলঙ্গি ও চূর্ণির জলস্তর ধীরে ধীরে কমছে। ফলে সব এলাকা থেকেই বন্যার জল কমবেশি সরতে শুরু করেছে। বাড়িও ফিরছেন কেউ কেউ। তবে ভাগীরথী এবং জলঙ্গির জলস্তর নামলেও এখনও তা চরম বিপদসীমার উপর দিয়েই বইছে। নবদ্বীপ-সহ জেলার বড় একটি অংশের বন্যা নির্ভর করে পার্শ্ববর্তী কাটোয়ার ভাগীরথী এবং অজয়ের উপর। দুটিরই জলস্তর কমায় নদিয়ার বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি হবে বলে আশা করছেন সকলে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, বন্যায় জেলার নবদ্বীপ, কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, শান্তিপুর, চাকদহ, কৃষ্ণনগর-১ নম্বর, হরিণঘাটা, রানাঘাট প্রভৃতি এলাকার প্রায় দু’লক্ষ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। তবে জেলার মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা নবদ্বীপ ব্লকের আটটি পঞ্চায়েত এবং নবদ্বীপ পুর এলাকার ২৪টি ওয়ার্ড। নবদ্বীপের ফকিরডাঙ্গা-ঘোলাপাড়া পঞ্চায়েতটি এখনও সংযোগ বিচ্ছিন্ন। মায়পুর-বামুনপুকুর, মহিশুরা পঞ্চায়েতের অবস্থাও তথৈবচ। নবদ্বীপ পুরসভার ২৪টি ওয়ার্ডই জলমগ্ন। প্রায় পঞ্চাশ হাজার মানুষ ছোটবড় মিলিয়ে শতাধিক ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। নবদ্বীপ ধাম এবং বিষ্ণুপ্রিয়া হল্ট স্টেশনেও ঠাঁই নিয়েছেন বানভাসিদের একাংশ। বাদ পড়েনি মঠ মন্দিরের চাতাল। তবে সর্বত্রই বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে।
বন্যায় রানাঘাটের ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামগুলির বেশির ভাগই-১ নম্বর ব্লকের মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে ন-পাড়া মাসুন্ডা, গোঁসাইচর, সাহেবডাঙ্গা, বিদ্যানন্দপুর, ভুঁইয়াপাড়া, আঁইশতলা, রামনগর, পারনিয়ামতপুর, বেলেরহাটি প্রভৃতি অঞ্চল। সব মিলিয়ে কমবেশি ১৮ হাজার মানুষ জলবন্দি হয়েছেন। তার মধ্যে আড়াই হাজার মানুষকে উনিশটি ত্রাণশিবিরে স্থানান্তরিত করা হয়। এলাকার গবাদি পশুদের জন্য কয়েকটি পৃথক শিবির খোলা হয়েছে। এই এলাকায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ন-পাড়া মাসুন্ডা পঞ্চায়েতের। গোটা পঞ্চায়েতের বেশিরভাগ মানুষই বানভাসি হয়ে ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। স্থানীয় উপপ্রধান তৃণমূলের মঙ্গল ঘোষ বলেন, “পঞ্চায়েতের তেরোটি বুথের মধ্যে বারোটিই জলের তলায়। দু’হাজার মানুষকে ন’টি ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন।’’ এলাকার চার হাজার হেক্টর জমির ধান, পাট এবং সব্জি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। তবে জল দ্রুত কমছে। প্রতিদিন গড়ে এক থেকে দেড়ফুট করে জলস্তর নামছে বলে দাবি করেন তিনি।
বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে চাকদহেও। স্থানীয় চরবীরপাড়া, সরডাঙ্গা, চরমাজদিয়া, চরযাত্রাসিদ্ধি, চরযদুবাটি, গঙ্গাপ্রসাদপুর, সরাটি, দুর্গাপুর প্রভৃতি এলাকার বহু মানুষ এ বারের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। তবে এই সব অঞ্চলের মধ্যে কাঁচরাপাড়া পঞ্চায়েতের প্রায় ৯৫ শতাংশ এবং সরাটির ৮৫ শতাংশ মানুষ এ বার বন্যা কবলিত হয়েছিলেন। স্থানীয় প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, সব মিলিয়ে পঞ্চাশ হাজার মানুষ জলবন্দি হয়ে ছিলেন। তার মধ্যে ১৮ হাজার বানভাসি মানুষ ৬৭টি ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নেন। তবে জল কমতে শুরু করায় অনেকেই নিজের বাড়িতে ফিরতে শুরু করেছেন। কল্যাণী মহকুমাশাসক স্বপন কুমার কুণ্ডু বলেন, “প্লাবিত এলাকায় জল কমছে। ঘরে ফিরছেন ত্রাণশিবিরে থাকা মানুষ। যারা ঘরে ফিরছেন তাঁদের যাতে কোনও সমস্যা না হয় তার জন্য প্রশাসনের তরফ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।”

জেলার সেচ দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার বিকেল ৪টের সময় নবদ্বীপের স্বরূপগঞ্জের কাছে গঙ্গার জলস্তর ৯.৬৭ সেমিতে নেমে এসেছে। গত বুধবার রাতে জলস্তর চরম বিপদসীমা ৯.০৫ সেমি ছাড়িয়ে ৯.৯৭ সেমিতে পৌঁছে গিয়েছিল। অন্য দিকে, চূর্ণির জলস্তর এখনও বিপদসীমার উপর দিয়েই বইছে। জেলা সেচ দফতরের কৃষ্ণনগরের এসডিও সুবীর রায় জানিয়েছেন, বন্যা পরিস্থিতি স্থিতিশীল। সব জায়গা থেকেই জলস্তর নামছে। তবে সর্বত্র জলস্তর নামার হার সমান নয়। এই মুহূর্তে জেলার নদীবাঁধ নিয়ে কোনও আশঙ্কা নেই।

দফতর সূত্রে খবর, চলতি বছরের প্রথম ছ’মাসে জেলায় মোট বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিল ৬৫৮.৮ মিলিমিটার। সেখানে শুধু জুলাই মাসে বৃষ্টি হয়েছে ৬৪৭.৮ মিলিমিটার। রাজ্য জুড়ে অতিবর্ষণই এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ডেকে এনেছে—এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

নদিয়ার সদর মহকুমা শাসক মৈত্রেয়ী গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “বন্যায় সবচেয়ে খারাপ অবস্থা নবদ্বীপের। ব্লকের আটটি পঞ্চায়েতই জলমগ্ন। সম্পূর্ণ প্লাবিত হয়েছে পুরসভা।’’ তিনি জানান, এ ছাড়াও বন্যা পরিস্থিতি হয়েছে কালীগঞ্জ, নাকাশিপাড়া, কৃষ্ণনগর-১ এবং ২ নম্বর ব্লকে। তবে জল নামতে শুরু করেছে বিভিন্ন এলাকা থেকে। ত্রাণশিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষজন ঘরেও ফিরতে শুরু করেছেন। অবস্থার উন্নতি হওয়ায় কিছ কিছু জায়গায় ত্রাণশিবির থেকে লোকজন চলে যাওয়ায় সেগুলি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যেসব জায়গায় এখনও মানুষ ত্রাণশিবিরে আছেন সেখানে রান্না করা খাবার, পানীয় জল, শিশুদের বেবিফুড দেওয়া হচ্ছে।

এই বন্যায় চরম ক্ষতির মুখে নদিয়ার কৃষি। ধান থেকে শাকসব্জি, পাট থেকে পান সবই ক্ষতির মুখে। জেলা কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত নদিয়া জেলার ১৭টি ব্লকের প্রতিটিই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জেলার প্রায় সাতশো মৌজার ফসল জলের তলায় চলে গিয়েছে।

নদিয়ার উপ-কৃষি অধিকর্তা (প্রশাসন) বিকাশচন্দ্র বিশ্বাস জানিয়েছেন, মোট ৫৯ হাজার ২২৫ হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।এর মধ্যে কৃষিজ ফসল এবং বাগিচা ফসল দুই-ই রয়েছে। নষ্ট হয়ে গিয়েছে প্রায় আড়াই লক্ষ মেট্রিক টন ফসল। যার আর্থিক মূল্য প্রায় ২৮০.৫ কোটি টাকা। তবে কৃষি দফতরের কর্তাদের অনুমান, এখনও সব জায়গায় বন্যার জল নামেনি। জল নামলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বাড়বে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছিলেন নবদ্বীপের বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা। রবিবার নৌকায় ত্রাণসামগ্রী চাপিয়ে নবদ্বীপের অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত মহিশুড়া, বাহিরচড়া, ঘোলাপাড়া প্রভৃতি এলাকায় যান এলাকায় পরিচিত ‘নন্দদা’। বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বানভাসি মানুষের হাতে ত্রিপল তুলে দেন। এ দিন তিনি কয়েক’শো ত্রিপল এবং বেশ কিছু পলিথিন রোল পৌঁছে দেন।

পাশাপাশি বন্যার্তদের সাহায্য করতে ইতিমধ্যেই নেমে পড়েছেন সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলো। নবদ্বীপের বিভিন্ন বন্যা কবলিত অঞ্চলে টানা পাঁচদিন ধরে ত্রাণ বিতরণ করলেন রামকৃষ্ণ মিশনের কলকাতা বিদ্যার্থী আশ্রমের বেলঘরিয়া শাখা। স্বামী বলদেবানন্দ মহারাজের তত্ত্বাবধানে মোট ৩৬১৮ পরিবারের ১২৬৮৯ জনের ত্রাণসামগ্রী তুলে দেওয়া হয়। এদের মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার শিশু ছিল। ভারত সেবাশ্রমের নবদ্বীপ শাখার তরফে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নেওয়া বন্যার্তদের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌছে দেওয়ার হচ্ছে। রবিবার পর্যন্ত ১২০০ পরিবারের কাছে পৌঁছেছেন তাঁরা। ত্রাণকার্যে নেমেছে নবদ্বীপ লায়ন্স ক্লাব সহ শহরের বিভিন্ন ক্লাব। স্থানীয় তৃণমূলের তরফে প্রায় প্রতিটি ওয়ার্ডে দলের তরফ থেকে রান্না করা খাবার পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে সংলগ্ন এলাকার বানভাসিদের কাছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Flood nadia ranaghat water rain
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE