জলস্তর নেমে যাওয়ায় অকেজো হয়ে পড়েছে জেটি। — নিজস্ব চিত্র
বছর তিরিশ আগের কথা।
সময়টা আটের দশক। সে বারও শীতের শেষাশেষি গঙ্গার জল হু হু করে কমে যাচ্ছিল। নবদ্বীপ আর মায়াপুরের মাঝখানে গঙ্গার বুকে জেগে উঠেছিল বিরাট চর। নবদ্বীপ থেকে মায়াপুর যেতে নৌকা বদল করতে হত। ঘাট থেকে চর পর্যন্ত পৌঁছে দিত একটি নৌকা, পায়ে হেঁটে চর পার হয়ে ফের আর একটি নৌকায় করে মায়াপুর যেতে হত। রাতে আলো জ্বালিয়ে সেই চরের বুকে পিকনিকের কথা এলাকার প্রবীণদের স্মৃতিতে এখনও উজ্জ্বল।
বহু দিন পরে গঙ্গার জলস্তর নিয়ে প্রায় একই রকম সঙ্কটে নবদ্বীপ। এ বার প্রধান কারণ বিহারে যথাসময়ে বৃষ্টি না হওয়ায় গঙ্গার অববাহিকা শুকিয়ে যাওয়া এবং তার উপরে বাংলাদেশকে জল দেওয়ার চাপ। যার জেরে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে ফরাক্কা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন। সেই জলসঙ্কট ক্রমশ নদিয়া হয়ে দক্ষিণে নামছে। যার পরিণতিতে নবদ্বীপ, মায়াপুর, স্বরূপগঞ্জের মধ্যে নৌকা চলাচল বিপর্যস্ত হয়ে গিয়েছে। দোলের সময় এই পরিস্থিতি হওয়ায় উদ্বেগে দিন কাটাচ্ছেন মাঝি থেকে মঠের মোহান্ত, সকলেই।
নবদ্বীপ জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতির সম্পাদক অলোক মণ্ডল বলেন, “চৈত্র-বৈশাখে প্রতি বারই জল তলানিতে ঠেকে। কিন্তু এ বার যেভাবে ফাল্গুনের মাঝামাঝি থেকে জল নামতে লেগেছে, তা কোনও দিন দেখিনি। এমন চলতে থাকলে শেষ পর্যন্ত খেয়া বন্ধ হয়ে যাবে।”
নদীতে জল না থাকায় যাত্রী-বোঝাই নৌকার মোটরের পাখা ও ‘শ্যাফট’ পাড়ের পাথর, বোল্ডার, নদীগর্ভে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে যাচ্ছে। মাঝনদীতে যন্ত্রাংশ ভেঙে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দু’তিন কিলোমিটার ভেসে যাচ্ছে নৌকা। কখনও-কখনও ভেসে গৌরাঙ্গ সেতুর তলা পর্যন্ত চলে যাওয়া নৌকা ফেরাতে হিমশিম খাচ্ছেন মাঝিরা। দোলে কয়েক লক্ষ মানুষের সমাগম হলে কী পরিস্থিতি হবে, তা ভাবতেই আঁতকে উঠছেন সকলে।
নবদ্বীপে গঙ্গা ও জলঙ্গি দিয়ে মোট তিনটি রুটে ছ’টি জেটিতে ফেরি চলে। নবদ্বীপ ঘাটের দু’টি জেটি থেকে নবদ্বীপ-মায়াপুর এবং নবদ্বীপ-স্বরূপগঞ্জ রুটে নৌকা চলাচল করে।
অন্য দিকে, মায়াপুরের হুলোর ঘাট থেকে জলঙ্গি দিয়ে মায়াপুর-স্বরূপগঞ্জ রুটে নৌকা চলে। গঙ্গার জল কমে যাওয়ায় জলঙ্গির জলস্তরও নেমে গিয়েছে। নবদ্বীপের দিকে জেটি দু’টি ছাড়া মায়াপুর এবং স্বরূপগঞ্জের চারটি জেটির স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। মূল খেয়াঘাটের দু’শো থেকে তিনশো মিটার দূরে আঘাটায় অস্থায়ী বাঁশের মাচা দিয়ে নৌকায় ওঠানামা করতে হচ্ছে।
স্বরূপগঞ্জের দিকে মূল ভাসমান জেটির কাছে জলস্তর এতটাই কমে গিয়েছে যে এলাকার ছেলেরা সকাল বিকেল হাঁটুজলে খেলা করছে। এক দিকে অকেজো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে নতুন আনা যাত্রিবাহী লঞ্চ। সোমবার নবদ্বীপ জলপথ পরিবহণ সমবায় সমিতির সভাপতি গোপাল দাস দাবি করেন, “গত এক দিনে জলস্তর নেমে গিয়েছে প্রায় দেড়ফুট।
ফলে, সব ঘাটই আমরা সরাতে বাধ্য হয়েছি। অস্থায়ী এই সব ঘাটে নতুন করে সব ব্যবস্থা করতে হচ্ছে— আলো থেকে শেড। প্রচুর বাঁশের মাচা তৈরি করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে বিরাট আর্থিক দায় বহন করতে হচ্ছে।”
সমিতির তরফে জেলা পরিষদেও বিষয়টি জানানো হয়েছে। সভাধিপতি বাণী রায় বলেন, “সমস্যা সামাল দেওয়ার সব রকম চেষ্টা চলছে। ওই এলাকায় সেচ দফতরের সঙ্গে যৌথ ভাবে ড্রেজিং করা যা কি না, তা নিয়ে একটি সমীক্ষা করছেন উভয় দপ্তরের ইঞ্জিনিয়ারেরা।” তবে নির্বাচন ঘোষণা হয়ে যাওয়ায় যে ‘ইচ্ছা’ থাকলেও অনেক কিছুই করতে পারবেন না, তা-ও তিনি জানাতে ভোলেননি।
স্বরূপগঞ্জে জেলা সেচ দফতরের তরফে জলস্তর মাপার কাজও বন্ধ হতে বসেছে। সেচ দফতরের এসডিও সুবীর রায় বলেন, “যেখানে আমরা জল মাপি, সেখানে জলই নেই। শুধু পলি আর কাদা।” জলস্তর যে ভাবে নামছে তাতে বিভিন্ন জায়গায় স্নানের ঘাট নির্মাণের কাজও ব্যাহত হচ্ছে।
সুবীরবাবু বলেন, “বেশির ভাগ জায়গায় ওই সব ঘাট নির্মাণের জন্য ভিত্তি দেওয়াল গাঁথা হয়েছিল। এখন জল সেখান থেকে দশ-বারো ফুট দূরে সরে গিয়েছে। এমন অবস্থা আগে কখনও তৈরি হয়নি।” কবে উত্তর থেকে দু’পাড় ছাপিয়ে জল নেমে আসে, তারই প্রতীক্ষায় চাতক হয়ে আছে নবদ্বীপ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy