সময়টা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। কাতারে কাতারে মানুষ সীমান্ত পেরিয়ে এই দেশে ঢুকছেন। সীমান্তের গ্রামগুলিতে শরণার্থীদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করা হয়। ওই বছরই আবার হয়েছিল বন্যা। ইছামতি নদীর জলে প্লাবিত হয় সীমান্তের গ্রামগুলি। বাধ্য হয়ে শরণার্থীদের আশ্রয় নিতে হয় প্রধান সড়কে।খোলা আকাশের নীচে।
সে সময়ে দত্তপুলিয়া হাসপাতালের চিকিৎসক বীরেন্দ্র ভূষণ সরস্বতীর ছেলে জ্যোতির্ময় রানাঘাট পালচৌধুরী উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র। তাঁদের বাড়ির বিস্তর বাগানেই ভারতীয় মিলিটারি পুলিশের অস্থায়ী শিবির তৈরি হয়েছিল। জ্যোতির্ময়ের বর্তমান বয়স ৬৮। গত কয়েক দিন ধরে কাশ্মীর, পঞ্জাব, রাজস্থানের আকাশে যুদ্ধ বিমানের আনাগোনা চলছিল। সেই খবর কাগজে দেখে মনে পড়ে যাচ্ছে ৫৪ বছর আগের পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের স্মৃতি। সে দিনের সেই বাগান আজও রয়েছে। নেই শুধু সেনা ছাউনি।
দত্তপুলিয়া থেকে বাংলাদেশ সীমান্তের দূরত্ব খুব বেশি হলে দেড় কিলোমিটার। একাত্তরের যুদ্ধের সময়ে কেমন ছিল সীমান্তের এই গ্রাম? শনিবার বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলেন জ্যোতির্ময়। তত ক্ষণে ভারত ও পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির খবর এসে পৌঁছেছে। ১০ মে বিকাল পাঁচটা থেকে দুই পক্ষই গোলাগুলি বন্ধ রাখবে, আলোচনায় ঠিক হয়েছে। স্মৃতি হাতড়ে জ্যোতির্ময় বলেন, ‘‘গ্রামের অনতিদূরে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শিবির আগে থেকেই ছিল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে উন্মুক্ত করে দেওয়া হয় সীমান্ত। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভারতীয় মিলিটারি এলাকায় আসতে শুরু করে। ১৭ থেকে ২১ বছর বয়সের যুবকেরা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে দত্তপুলিয়ায় আসতেন। জানলাম, ওঁরা মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ নিতে এখানে আসছেন। তাঁদের অনেকের সঙ্গেই বন্ধুত্ব হয়েছিল।’’
খুব কাছ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং তাতে ভারতীয় সেনার অংশগ্রহণ দেখেছেন সে দিনের স্কুলপড়ুয়া বছর চোদ্দোর জ্যোতির্ময়। পাক সেনার বিরুদ্ধে ভারতীয় সেনার যুদ্ধ যখন মধ্যগগনে, হঠাৎ এক এক দিন পাক যুদ্ধবিমান গ্রামের আকাশে দেখেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘সে সময়ে ভারতীয় যুদ্ধবিমান ন্যাট পাক যুদ্ধবিমানের পিছু নিয়েছিল। কিছু ক্ষণের মধ্যেই বাগদার কাছে নামানো হয় পাকিস্তানের ওই বিমানকে।’’ আবার, এক দিন বাড়ির পাশের ওই বাগানে সেনা ছাউনি করা হবে বলে জ্যোতির্ময়ের বাবাকে প্রস্তাব দেয় ভারতীয় সেনা। এককথায় তাতে সম্মতিও দিয়েছিলেন বাবা। সরস্বতী বাড়ির বাগানে ওই শিবিরটি ছিল মিলিটারি পুলিশের। যে সকল সেনা কর্মীরা যুদ্ধে যেতেন, তাঁদের যাবতীয় বন্দোবস্ত করাই ছিল মিলিটারি পুলিশের কাজ।
স্মৃতি-বিভোর জ্যোতির্ময় বলছিলেন, ‘‘পাক সেনার অন্যতম ঘাঁটি যশোর ক্যান্টনমেন্টে দখল নিতে ভারতীয় সেনাকে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। অনেক সেনাকর্মী নিহত হয়েছিলেন। তাঁদের দেহ গ্রামের রাস্তা দিয়েই ফিরেছে।’’
এতগুলো বছর পর আবার পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যদিও দুই প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা। তবু স্মৃতিতে ভিড় করছেমুক্তিযুদ্ধের অতীত।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)