Advertisement
E-Paper

কৃষ্ণনগরের গ্রামে গ্রামে ‘অপুষ্টি বিরোধী অভিযান’! সুষম খাদ্য, ওষুধ দিচ্ছে পুলিশ, বিভ্রান্তিতে শাসকদলের জনপ্রতিনিধিরাই

পাঁচটি গ্রামে বিশেষ স্বাস্থ্যশিবির করে সরকারি চিকিৎসকদের মাধ্যমে ‘অপুষ্টির শিকার’ হওয়া প্রায় ১৫০ গ্রামবাসীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে পুলিশ।

প্রণয় ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৯ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:২০
malnurtrition

পুলিশের উদ্যোগে কৃষ্ণনগরে স্বাস্থ্যশিবির। ছবি: সংগৃহীত।

নদিয়ার একাধিক গ্রামে অপুষ্টির শিকার বহু বাসিন্দা। খোঁজখবর নিয়ে এ কথা বলছে পুলিশ-ই। শুধু তাই নয়, অপুষ্টি দূর করারও কর্মসূচি নিয়েছে তারা। ইতিমধ্যে কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলায় শুরু হয়ে গিয়েছে ‘পাইলট প্রজেক্ট।’ তেহট্ট মহকুমার পাঁচটি থানা এলাকার পাঁচটি গ্রামকে চিহ্নিত করে কাজ শুরু করেছে পুলিশ। কিন্তু পুলিশের ‘অপুষ্টি-তত্ত্বে’ একমত নন জেলা প্রশাসন থেকে শাসকদলের প্রতিনিধিরা।

বিশ্বে প্রতি বছর ৫০ লক্ষেরও বেশি শিশু মারা যাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে অন্তঃসত্ত্বা মহিলাদের স্বাস্থ্যহানি, জটিল রোগ-ব্যাধির প্রকোপ, সুষম খাদ্য ও চিকিৎসার অভাব, পরিবেশ, অশিক্ষা, কুসংস্কার, ধর্মীয় অনুশাসন ইত্যাদি। তা ছাড়াও পুষ্টিহীনতা, দারিদ্র, অর্থনৈতিক সমস্যা এবং অজ্ঞতা। পুষ্টির অভাবে শারীরিক এবং আচরণগত ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি ব্যাধি দেখা দিতে পারে। এখন স্বাস্থ্যশিবিরের মাধ্যমে সেই গ্রামবাসীদের চিহ্নিত করে বিনামূল্যে সুষম খাবার এবং ওষুধপত্র পৌঁছে দিচ্ছে কৃষ্ণনগরের পুলিশ।

হঠাৎ এমন প্রকল্পের প্রয়োজন পড়ল কেন? কেনই বা সেই উদ্যোগ নিতে হচ্ছে পুলিশকে? জেলা পুলিশের দাবি, কারণটা সম্পূর্ণ মানবিক। তারা খোঁজ নিয়ে দেখেছে, অপুষ্টিজনিত অসুখে এলাকায় অনেকে আক্রান্ত। তাঁদের সকলেই যাতে ঠিকঠাক চিকিৎসা পান, কাউকে যাতে খিদের জ্বালায় কষ্ট পেতে না হয়, সে জন্য স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে এই উদ্যোগ।

তা-ও ‘কিন্তু’ রয়েছে।

বয়স্ক এবং দুঃস্থদের ভাতা-সহ একাধিক সুবিধা দিতে বিভিন্ন প্রকল্প রয়েছে রাজ্য সরকারের। গ্রামীণ হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা, রোগনির্ণয় থেকে প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়ারও ব্যবস্থা আছে। রয়েছে ‘খাদ্যসাথী’-র মতো প্রকল্প। যেখানে রেশন ব্যবস্থায় রাজ্যের প্রায় ১০ কোটি মানুষই বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী পান। এত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও একটি পুলিশ জেলার গ্রামীণ এলাকার মানুষ কেন ‘অপুষ্টির শিকার’ হচ্ছেন, সেই প্রশ্ন উঠছে।

কৃষ্ণনগর জেলা পুলিশ সমাজমাধ্যমে ছবি পোস্ট করে দাবি করেছে, ‘অপুষ্টির সমস্যা নির্মূল’ করতে কৃষ্ণনগর পুলিশ জেলার তেহট্ট মহকুমার পাঁচটি গ্রামকে বেছে নিয়ে পাইলট প্রজেক্ট শুরু করেছে। এই প্রকল্পে দুঃস্থ এবং সাধারণ মানুষদের জন্য নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী এবং ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। কেউ যাতে রোগভোগে আক্রান্ত না-হন এবং খিদেয় কষ্ট না পান, সে জন্য এমন উদ্যোগ। জানা যাচ্ছে, পলাশিপাড়া থানার রানিনগরের সর্দারপাড়া, করিমপুর থানার গোয়াস মালপাড়া, থানার পাড়ার পিপুলখোলা, মুরুটিয়া থানার চকমারোয়া এবং হোগোলবেড়িয়া থানার জামশেরপুর-সর্দারপাড়ায় এই প্রকল্প শুরু হয়েছে। পাঁচটি গ্রামে বিশেষ স্বাস্থ্যশিবির করে সরকারি চিকিৎসকদের মাধ্যমে ‘অপুষ্টির শিকার’ হওয়া প্রায় ১৫০ গ্রামবাসীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের দেখভালের দায়িত্ব নিয়েছে পুলিশ। ভবিষ্যতে অন্য গ্রামে এই সুস্বাস্থ্য শিবির অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে পুলিশ। বলা হয়েছে, বিশেষ নজর থাকবে অন্তঃসত্ত্বা, সদ্যোজাত শিশু এবং বয়স্কদের ওপর। এ ছাড়াও আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া কিছু পরিবারকে সুস্বাস্থ্য কার্ডও দেওয়া হবে। যেখানে পুষ্টিজনিত খাবার সংক্রান্ত সমস্ত তথ্য লেখা থাকবে। সেই খাবার পুলিশের তরফ থেকেই ওই বাসিন্দার বাড়িতে পৌঁছে দেওয়া হবে। শুধু তাই নয়, চিকিৎসক যদি অপুষ্টিজনতি অসুখে ভোগা রোগীকে বিশেষ কোনও ওষুধ খাওয়ার পরামর্শ দেন, তার ব্যবস্থাও করবে পুলিশ। তা ছাড়াও প্রতিটি গ্রামে অন্তত এক জন দুঃস্থ ব্যক্তিকে বেছে নিয়ে তাঁর ভরণপোষণের সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেবে তারা।

তবে কি রাজ্য সরকারের সামাজিক প্রকল্পগুলি অপুষ্টি ও দারিদ্র দূরীকরণে পর্যাপ্ত নয়? কৃষ্ণনগরের পুলিশ সুপার অমরনাথ কে বলেন, ‘‘গ্রামের অনেকে আছেন, যাঁদের আর কর্মক্ষমতা নেই এবং তাঁরা অপুষ্টি ও অনাহারে রয়েছেন। সেই সমস্ত মানুষকে চিহ্নিত করে থানা থেকে কার্ড করে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং বিভিন্ন রকম পুষ্টিকর খাবার থানার মাধ্যমেই দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকার মানুষেরা, যাঁরা থানায় যেতে ভয় পান, পুলিশের সঙ্গে যাঁদের যোগাযোগ প্রায় নেই, সেই সমস্ত গ্রামকেই বেছে নিচ্ছে পুলিশ।’’

যদিও পুলিশের এই ‘অপুষ্টি তত্ত্ব’ নিয়ে পুরোপুরি একমত নন শাসকদলের জনপ্রতিনিধিরা। করিমপুরের তৃণমূল বিধায়ক বিমলেন্দু সিংহ রায়ের মন্তব্য, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার রাজ্যের প্রতিটি মানুষের অন্ন, বস্ত্র এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করেছেন। এ রাজ্যে কোথাও অনাহার নেই। পুলিশকে কে কী ভাবে কী বলছে, তারা কী করছে, সেটা আমি বলতে পারব না।’’ পুলিশের প্রকল্প নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি না হলেও রহমতপুর গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান শম্পা বিশ্বাসের কথায়, ‘‘আমরা মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। পঞ্চায়েত থেকে পর্যাপ্ত সাহায্য নির্দিষ্ট সময় অন্তর পৌঁছে দেওয়া হয়। কোথাও মানুষ না খেয়ে নেই।’’

ওই পাঁচ গ্রামের বাসিন্দাদের দাবি, ‘খাদ্যসাথী’, বার্ধক্য ভাতা-সহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেলেও তা তাঁদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। পুলিশের কথায় ‘অপুষ্টিতে আক্রান্ত’ জামশেরপুর-সর্দারপাড়ার বাসিন্দা নারায়ণ সর্দার বলেন, ‘‘বার্ধক্য ভাতার এক হাজার টাকা পাই, মাসে পাঁচ কেজি করে চালও পাই। কিন্তু পাঁচ কেজি চালে একটা মানুষের কি একমাস চলে? ১০০০ টাকায় এখন আর কী হয় বলুন? ওষুধ খাব না দু’বেলা দু’মুঠো ভাত খাব?’’ তবে পুলিশের এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দিহান তাঁরাও। তবু উদ্যোগে খুশি গোয়াস মালপাড়ার লক্ষ্মীরানি। তিনি বলেন, ‘‘অনেকেই অনেক কিছু বলে। এখন পুলিশ বলছে। দেখি কত দিন হয়।’’

ও দিকে, পুলিশ সুপারের বক্তব্যের ভিন্ন সুরে নদিয়ার জেলাশাসক অনীশ দাশগুপ্তের। তিনি বলেন, ‘‘সদ্য দায়িত্ব নিয়ে জেলায় এসেছি। তবে কোথাও অনাহার কিংবা অপুষ্টি আছে বলে এখনও খবর পাইনি। পুলিশ কী প্রকল্পে কী ভাবে কী কাজ করছে, সেটা ওরাই ভাল বলতে পারবে।’’

Malnutrition Krishnagar police TMC government
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy