যানজটের ফলে লেন ভেঙে চলছে গাড়ি। আহিরণের কাছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে। — নিজস্ব চিত্র
দুমড়ানো মুড়ির টিনের মতো স্কুলভ্যানটা ফরাক্কা থানায় পড়ে রয়েছে।
লতানো পরাশ্রয়ীর দখলদারির আড়ালে, মাস ছয়েক আগের সেই সকালটা ভাঙাচোরা গাড়িটার আনাচকানাচে এখনও ধরা আছে— তিনটে ফুটফুটে স্কুল-বালক আর গাড়ির চালক, মুখগুলো চোখ বুজলেই দেখতে পান ফরাক্কা থানার ট্রাফিক কন্ট্রোলের সেই অফিসার।
অপুলিশ সুলভ হতাশা থেকে যিনি এনও আক্ষেপ করছেন, ‘‘উন্নয়ন হলেই তো হবে না, মানসিকতাটাও বদলাতে হবে। এখন তো দাঁডডিয়ে গেছে চওড়া রাস্তায় বেয়াড়া চালকের দৌরাত্ম্য।’’
আক্ষেপটা থানায় থানায় ছড়িয়ে রয়েছে যেন। মুর্শিদাবাদ কিংবা পড়শি নদিয়া— ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক বুকে নিয়ে পড়ে থাকা দুই জেলায় শীর্ণ রাস্তাটা কোথাও ছোট নদীর মতো ছ’লেনের কোথাও বা দুই। তাতে কি এসে যায়। চালকদের মানসিকতাটা পড়ে রয়েছে বিশ বছর আগের কোনও রাস্তায়। অবিরল লেন-ভাঙার খেলা আর অহরহ দুর্ঘটনা— দুই জেলার ট্রাফিক অফিসারেরা তাই বলছেন, ‘‘রাস্তা বদলেছে কিন্তু মানুষগুলো তো বদলায়নি!’’ এখনও তাই ক্রমাগত দুর্ঘটনা আর নিরন্তর মৃত্যু।
যে তালিকায় শেষ সংযোজন সমশেরগঞ্জের তারাপুর। মঙ্গলবার, প্রৌঢ় বাবাকে মোটরবাইকের পিছনে বসিয়ে ‘নিশ্চিন্তে’ লেন ভাঙার খেসারত দিলেন দু’জনেই।
প্রসারিত হচ্ছে জাতীয় ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক। দুই থেকে চার লেন হয়েছে, কোথাও বা আরও খানিক চওড়া। নদিয়ায় তেমন প্রসার নেই ঠিকই, তবে উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির তোয়াক্কা না করার ‘ডোন্ট কেয়ার’ মনোভাবটা এড়াবে কে? ফলে দুর্ঘটনা চলছেই। আর তার জেরে মানুষের সচেতনতা না ফিরুক, রাস্তা অবরোধ করার প্রবণতায় ভাঁটা পড়েনি। ফলে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্ভোগ। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের হিসেব বলছে— বহরমপুর থেকে ফরাক্কা, ২০১৪’র জুন থেকে ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনার সংখ্যা ২৭৯। মৃত্যু ৮০। আহতের সংখ্যা ৫১২ জন।
আর চলতি বছরের ৩ নভেম্বর পর্যন্ত, ১০৭টি দুর্ঘটনায় ৩৫ জন মারা গিয়েছেন। আহত ১৬৩ জন।
জাতীয় সড়ক সুত্রে জানা গিয়েছে, দুর্ঘটনাগুলির ২৯২টির ক্ষেত্রে গাড়ির গতি ছিল নির্ধারিত গতির তিন গুণ আর, সবক’টি ক্ষেত্রেই আঙুল উঠেছে,পুরনো রোগ, লেন ভাঙার দিকে। সেই তালিকায় যেমন রয়েছে লছিমনের চালক-সহ ভ্যানের সাত যাত্রীর মৃত্যুর ঘটনা কিংবা বল্লালপুরের কাছে ছাত্র বোঝাই পুলকার-ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষ।
নদিয়ায় অবশ্য জাতীয় সড়ক তেমন প্রশস্থ নয়। রাস্তা চওড়া করার কাজে সেখানে হাত পড়েনি সবর্ত্র। তবে প্রশ্নটা যে ‘মানসিকতা’র তা দুর্ঘটনার রকম দেখেই মালুম হয়। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে সংঘর্ষটা মুখোমুখি এবং তা লেন ভেঙে উল্টো দিক থেকে আসা গা়ড়ির গতির তোয়াক্কা না করায়।’’
হিসেব বলছে— চলতি বছরে জুন মাস পর্যন্ত এই ধরনের দুর্ঘটনায় জাতীয় সড়কে মারা গিয়েছেন একশো জনেরও বেশি। যা নদিয়া জেলা জুড়ে বিভিন্ন দুর্ঘটনার পঁয়ত্রিশ শতাংশের বেশি। তা হলে উপায়?
জাতীয় সড়কে দুর্ঘটনায় রাশ টানতে নদিয়া জেলা পুলিশের দাওয়াই— অবিলম্বে জাতীয় সড়কে ইঞ্জিন ভ্যান চালানো নিষিদ্ধ করতে হবে। না হলে, চাকদহ-চৌরাস্তা, দিগনগর, যুগপুর, ঘাটেশ্বর, ভাতজাংলা রানাঘাট কিংবা ধুবুলিয়ার মতো এলাকায় দুর্ঘটনা আটকানো দুরূহ। সেই সঙ্গে রয়েছে ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের বেহাল অবস্থা।
রানাঘাট শহরের বুক ফুঁড়েই জাতীয় সড়কের প্রায় দু কিলোমিটার প্রসার। স্থানীয় পুরপ্রধান পার্থসারথী চট্টোপাধ্যায়ও এক মত, “সচেতনতার অভাব একটা বড় কারণ। চালক থেকে সাধারণ মানুষ সকলেরই সচেতনতার অভাব রয়েছে।” বহরমপুর থেকে ফরাক্কা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়কের যাত্রী সুরক্ষার ব্যাপারে দেখাশোনার দায়িত্বে রয়েছে হরিয়ানার গুরুগাঁওয়ের একটি বেসরকারি সংস্থা।
সংস্থার প্রকল্প আধিকারিক শ্যামতনু দত্ত জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষকে লিখিতভাবে দুর্ঘটনাপ্রবণ কয়েকটি এলাকার উল্লেখ করে দুর্ঘটনা রোধে কিছু সুনির্দিষ্ট কিছু প্রস্তাব দিয়েছেন।
বহরমপুর উত্তরপাড়া মোড়ে প্রচন্ড ট্রাফিকের চাপ থাকা সত্বেও সেখানকার সড়ক নির্মাণে গাফিলতি রয়েছে বলে অভিযোগ তুলেছেন তিনি। একই ভাবে রঘুনাথগঞ্জ উমরপুরে চার লেনের সড়ক তৈরি সম্পূর্ণ হলেও স্থানীয় বাধায় জমি না মেলায় ‘ডিজাইন’ ঠিকমতো করা হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে তাঁর। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য জাতীয় সড়ক তৈরির মূল নকশা মেনে উমরপুর জাংশনের কাজ শেষ করতে পরামর্শ দিয়েছে ওই সংস্থা।
তথ্য সূত্র: বিমান হাজরা, সুস্মিত হালদার
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy