Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
Gaya

হেঁটেই বাড়িতে ১২ নির্মাণ শ্রমিক

গোটা দেশে লকডাউন চলছে। দুই দফার লকডাউনে ইতিমধ্যেই নাস্তানাবুঁদ হয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা।

বাড়ি ফেরার পর। নিজস্ব চিত্র

বাড়ি ফেরার পর। নিজস্ব চিত্র

সন্দীপ পাল
কালীগঞ্জ শেষ আপডেট: ২৭ এপ্রিল ২০২০ ০৩:৩২
Share: Save:

পায়ে হেঁটেই বিহার থেকে বাড়ি ফিরবেন ঠিক করেন। আর তার পর বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়। এই অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখিয়েছেন কালীগঞ্জ এলাকার ১২ জন নির্মাণ শ্রমিক। সৌজন্যে শ্রমজীবী মানুষের পেটের খিদে আর বেঁচে থাকার জেদ।

গোটা দেশে লকডাউন চলছে। দুই দফার লকডাউনে ইতিমধ্যেই নাস্তানাবুঁদ হয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিকেরা। রাজ্যের বাইরে আটকে পড়া শ্রমিকেরা প্রতিনিয়ত সমস্যায় পড়ছেন। লকডাউনে কাজ হারিয়ে ঘরে বসে রয়েছেন ওঁরা। বাড়ি ফেরার গাড়ি-ট্রেন সব বন্ধ। এক দিকে, খাবার নেই। মাথার উপরে ছাপ নেই, ভাড়া বাড়ির টাকা দেওয়ার মতো রোজগার নেই। অন্য দিকে, অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে করোনা সংক্রমণ মিটলে বাড়ি ফেরার আশাটুকুও। জমানো টাকাও শেষ। ঠিকেদারও সাহায্য করা ছেড়ে দিয়েছেন। এই অবস্থায় বাঁচার আর উপায় না দেখে পায়ে হেঁটেই বাড়ি ফেরার কথা মনস্থ করে ফেলেন ওঁরা। টানা তিন দিন ধরে পায়ে হেঁটে বিহারের গয়া থেকে ওঁরা পৌঁছে গিয়েছেন কালীগঞ্জ এলাকায়।

তবে কালীগঞ্জ পৌঁছতেই বিষয়টি কালীগঞ্জ থানার পুলিশের নজরে আসে। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য স্থানীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। পরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে ওই বারো জনকে ১৪ দিনের হোম কোয়রান্টিনে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে তাতে কোনও ক্ষোভ নেই ওঁদের। ওই শ্রমিকদের কথায়, ‘‘নিজের বাড়ি ফিরতে পেরেছি, এতেই খুশি।’’

পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, কালীগঞ্জ এলাকার সাহাপুর, বসরখোলা ও বড়চাঁদঘর এলাকার বাসিন্দা ওই ১২ জন পরিযায়ী শ্রমিক।

ওই শ্রমিকেরা জানাচ্ছেন, তাঁরা সকলে একসঙ্গে গয়ায় নির্মাণ কাজের সঙ্গে যুক্ত এক ঠিকাদারের কাছে কাজ করছিলেন। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মাস আটেক আগে গিয়েছিলেন সেখানে। কেউ আবার মার্চ মাসে লকডাউন শুরু হওয়ার এক সপ্তাহ আগে। তবে লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকেই তাঁদের কাজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। জমানো টাকায় এই ক’দিন চালাচ্ছিলেন। শেষে টাকা শেষ হতে ঠিকাদারও হাত তুলে নেন।

পরে তাঁরা মোবাইলে খবর পড়েন, বিভিন্ন রাজ্যে থেকে পরিযায়ী শ্রমিকেরা পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরছেন। তখনই তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, প্রাণ বাঁচাতে শেষ চেষ্টা হিসাবে এটাই একমাত্র পথ।

কিছু শুকনো খাবার সঙ্গে নিয়ে বৃহস্পতিবার ভোরে তাঁরা বারো জন রওনা দেন বাড়ির উদ্দেশে। রাস্তার মাঝে কখনও পুলিশের সাহায্য মিলেছে। আবার কখনও পথচলতি গাড়ি কিছুটা পথ এগিয়ে দিয়েছে। এই ভাবে শনিবার রাতে ওই শ্রমিকেরা পৌছন কালীগঞ্জের ভাগ্যমান্তপুর ঘাটে। এর পর নৌকা ভাড়া করে ঘাট পার হতেই বিষয়টি কালীগঞ্জের পুলিশের নজরে পড়ে। তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর গাড়ি করে বাড়ি পৌঁছে দেওয়া হয়।

শ্রমিকদের মধ্যে সাহাপুরের সাবির মণ্ডলের কথায়, ‘‘কখনও পুলিশ দেখে ছুটেছি। কখনও অভুক্ত অবস্থাতেই হেঁটেছি মাইলের পর মাইল। কখনও আবার রাস্তা দেখিয়েছে পুলিশ।’’

সরখোলার এক শ্রমিক বাদশা শেখ বলছেন, ‘‘হাতের নগদ টাকা শেষ হয়ে যাচ্ছিল। সকলে মিলে ঠিক করি হেঁটে বাড়ি ফিরব। খাবর বলতে হাতে চিঁড়ে-মুড়ি ছাড়া কিছু ছিল না। রাস্তায়ও কোনও হোটেল খোলা পাইনি খাওয়ার জন্য। ওইটুকু খেয়েই পায়ে হেঁটে

বাড়ি এসেছি।’’

বড় চাঁদঘরের এক শ্রমিক জামিরুল শেখের কথায়, ‘‘দিনের বেলা হাঁটতে সমস্যা না হলেও রাত হতেই ভয় কাজ করেছে।’’ রাস্তা চিনতে সমস্যা হয়নি? তাঁর উত্তর, ‘‘মোবাইলে ম্যাপ দেখে আর স্থানীয় লোকজনকে জিগ্যেস করে রাস্তা চিনে এসেছি।’’ কিছু দিন আগেই একই ভাবে পরিযায়ী শিশুশ্রমিক জামলো মকদম তেলঙ্গানা থেকে হেঁটে বিজাপুরে ফিরতে গিয়ে বাড়ি থেকে কয়েক কিলোমিটার আগে প্রাণ হারায়। করোনা সংক্রমণ নয়, তার মৃত্যুর কারণ ছিল অপুষ্টি। তার পরেও একই কাজ করার সাহস পেলেন? উত্তরে ওই শ্রমিকেরা বলছেন, তাঁরা জামলোকে চেনেন না।

যদিও ওঁরা সবাই একই পথের পথিক। শুধু ভাগ্যের জেরে

পরিণতিটুকু আলাদা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Gaya Kaliganj
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE