সূর্য পাটে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। মেঠো রাস্তায় ধুলো উড়িয়ে একটি ট্রাক এসে থামল ডোমকলের একটি স্কুলের সবুজ মাঠে। পরের দিন ভোট। আর ওই স্কুলবাড়িটাই ভোটের বুথ। ট্রাক থেকে লোটাকম্বল নিয়ে নামলেন কয়েক জন ভোটকর্মী আর পুলিশ। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হল। গ্রাম থেকে পৌঁছে দেওয়া হল টাটকা আনাজ, দিশি মুরগি আর দুধ। সেই দুধের চায়ে ঘন ঘন চুমুক দিয়ে বেশ চনমনে ছিলেন ভোটবাবুরা!
এ দিকে রাত বাড়ছে। আরও গাঢ় হচ্ছে অন্ধকার। ঝিঁঝিঁর ডাক ছাড়া চারপাশে আর কোনও শব্দ নেই। পড়ুয়াদের বসার হাইবেঞ্চ দুটোকে জোড়া করে গুছিয়ে বিছানাও পাতলেন প্রিসাইডিং অফিসার। আশপাশে অন্য ভোটকর্মীরাও ঘুমোনোর আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কেউ আবার সবে নাকডাকাও শুরু করেছেন। এমন সময় বিকট শব্দ। আস্ত স্কুলবাড়িটাও যেন কেঁপে উঠল।
নদিয়ার সেই স্কুল শিক্ষক, প্রিসাইডিং অফিসার সটান দাঁড়িয়ে পড়লেন হাই বেঞ্চে। তাঁর কাঁপুনিতে কাঁপছে বেঞ্চ। অন্য ভোটকর্মীরাও কেউ উঠে দাঁড়িয়েছেন, কেউ আবার হ্যারিকেনটা কাছে টেনে নিয়েছেন। আচমকা ভ্যাঁ করে কাঁদতে শুরু করলেন প্রিসাইডিং অফিসার।
স্থানীয় কয়েক জন বাসিন্দা সেই কান্না শুনে ছুটে এসেছেন। তাঁরা ভরসা দিচ্ছেন, ‘‘কোনও ভয় নেই! এমনটা তো এখানে হামেশা ঘটে। এই আওয়াজেই আপনারা কাঁদছেন? আমাদের এখন এমন শব্দে ঘুমই ভাঙে না। ভয়ের কোনও কারণ নেই। নিশ্চিন্তে শুয়ে পড়ুন। যা হচ্ছে বাইরে হচ্ছে।’’
জলবিয়োগের জন্যও তখন বাইরে যাওয়ারও সাহস দেখাচ্ছেন না কেউ। ভোটকর্মীদের সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় যুবক মন্তাজ শেখ। তিনি তো ভোটবাবুদের এমন সব কাণ্ড দেখে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি দিচ্ছেন। তার পরে মন্তাজ বলছেন, ‘‘এই একটা শব্দ শুনে এমন করছেন আপনারা! এ তো সবে মহড়া। এর পরে বদলা হবে। আর কাল সকাল থেকে শুরু হবে আসল খেলা। তখন দেখবেন, এই স্কুলের মাঠেই আলু (বোমা) পড়বে।’’
ভোটকর্মীরা তখন কী করবেন, বুঝতে পারছেন না। যাইহোক এলাকার লোকজনের আশ্বাসে কিছুটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছিলেন প্রিসাইডিং অফিসার। বিছানায় আবার গা এলানোর চেষ্টা করছিলেন সবে। কিন্তু মন্তাজের কথায় আবার তিনি তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন। এ বার আর কোনও কথা না বলে নিজের ব্যাগ কাছে টেনে নিয়ে বিছানা গোটাতে শুরু করলেন সেই গভীর রাতেই। কারও কথায় কান নেই তাঁর। তিনি তখন বলে চলেছেন, ‘‘মরে গেলেও ভাল। এখানে ভোট করাতে আমি নেই।’’ পুলিশকর্মীরা অনেক চেষ্টাতেও তাঁকে থামাতে পারছেন না। তাঁর সেই একটাই কথা, ‘‘এখানে আর এক মিনিটও থাকা যাবে না। এ জায়গা কোনও ভাবেই নিরাপদ নয়।’’
কিন্তু চৌকাঠের বাইরে পা ফেলতে না ফেলতেই আবারও গুড়ুম। ফের ঘরের মধ্যে চলে আসেন প্রিসাইডিং অফিসার। তার পরে কিছুক্ষণ গুম মেরে থাকলেন। তার পরে চেয়ারে গিয়ে বসলেন। কিন্তু চেয়ার কাঁপছে।
সেই অবস্থাতেই কেউ কেউ আবার মন্তব্য করলেন, ‘‘ভিতরে থাকুন। ভাল থাকবেন। এই অবস্থায় বাইরে গেলে তো বেঘোরে মরবেন!’’ সারাটা রাত দু’চোখএর পাতা এক করতে পারেননি প্রিসাইডিং ্ফিসার। তবে ভোরের দিকে তিনি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম ভাঙে ভোটকর্মীদের ডাকে, ‘‘চলুন স্যর, ভোট নিতে হবে তো।’’ কোনও মতেই রাজি নন তিনি। শেষে নেতা আর পুলিশের ধমকানিতে বাধ্য হয়ে শুরু করেন ভোট। কিন্তু সকাল হলেও শান্তি নেই। বেলা যত গড়িয়েছে, বোমার শব্দ বেড়েছে। একটা সময় বুথের বাইরেও পড়েছে বোমা। আর বার বার চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন প্রিসাইডিং অফিসার। ভোট শেষে সন্ধ্যায় সদরে ফেরার সময় প্রণাম করেছেন মাটিকে। জনা কয়েক নেতা আর এজেন্ট এসে বলেছেন, ‘‘স্যর আবার আসবেন।’’ মাস্টারমশাই তাঁদের মুখের উপরে বলে দিয়েছিলেন, ‘‘মরে গেলেও না। দরকার হলে চাকরি ছেড়ে দেব। কিন্তু এই তল্লাটে আমি আর আসব না।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy