তৃণমূল ভবনে দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকা বৈঠকে নদিয়ার নেতা ও জনপ্রতিনিধিরা। শুক্রবার। নিজস্ব চিত্র
দোষ মানুষের নয়, দোষ নেতাদের। প্রয়োজনে সংগঠনে নতুন মুখ নিয়ে আসতে হবে। শুক্রবার কলকাতায় তৃণমূল ভবনে নদিয়া জেলার নেতা-জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে নতুন পর্যবেক্ষক রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়কে এমনই নির্দেশ দিলেন দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আগের পর্যবেক্ষক তথা মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায়ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
গত লোকসভা ভোটে নদিয়ার দুই কেন্দ্রের মধ্যে রানাঘাট হাতছাড়া হয়েছে তৃণমূলের। কৃষ্ণনগর কেন্দ্রে মহুয়া মৈত্র জিতলেও সেখানেও চাপ তৈরি হয়েছিল। এবং বিপুল সংখ্যক সংখ্যালঘু ভোট না থাকলে যে ওই কেন্দ্রও হাতছাড়া হতে পারত, তৃণমূল নেতৃত্ব তা ভালই জানেন।
সম্ভবত সেই কারণেই ভোটের পরে এই প্রথম দলনেত্রী শুধু নদিয়া জেলার নেতা-জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করলেন। কিন্তু অনেকের যেমন আশঙ্কা ছিল, তেমন রুদ্রমূর্তি তিনি ধারণ করেননি। বরং নরমে-গরমে বুঝিয়ে দিয়েছেন, গোষ্ঠীবাজি-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কোনও ভাবেই মেনে নেবেন না। শান্তিপুরে পুরপ্রধান অজয় দে এবং বিধায়ক অরিন্দম ভট্টাচার্যকে কোন্দল থামাতে বলে ফের সতর্ক করেন তিনি।
চাকদহের বিধায়ক তথা মন্ত্রী রত্না ঘোষকেও সতর্ক করেন নেত্রী। বহু বার বলা সত্ত্বেও ঝামেলা মিটছে না বলে আক্ষেপও করেন। রত্নার বিরোধী পক্ষ বলে পরিচিত চাকদহের প্রাক্তন পুরপ্রধান দীপক চক্রবর্তীকে তিনি বলেন, আর তিনি কোন কথাই শুনতে চান না। শান্তিপুর বিধানসভা এলাকায় ফল খারাপ কেন হল, অজয় দে-র কাছে নেত্রী তা জানতে চান। তৃণমূল সূত্রের খবর, অজয়-অরিন্দম দাঁড়িয়ে থাকাকালীনই মমতা বলেন, ‘‘যদি কেউ বিজেপি-তে চলে যেতে চান, তা হলে যেতে পারেন। দরজা খোলা আছে।’’ অজয় জানান, তিনি নেত্রী ও দলের প্রতি তিনি সম্পূর্ণ অনুগত। নেত্রী জানান, কথাটা তিনি অজয়ের উদ্দেশে বলেননি।
এ দিন গ্রাম পঞ্চায়েত প্রধান থেকে অঞ্চল সভাপতিদের মমতা পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, ‘কাটমানি’ খাওয়া বরদাস্ত করা হবে না। দলের বিপর্যয়ের পিছনে যে নেতাদের প্রতি সাধারণ মানুষরে বিতৃষ্ণা কাজ করেছে, তা-ও তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছেন। এবং সেই মুখগুলোকে সরিয়ে না দিলে বীতশ্রদ্ধ ভোটারেরা ফিরবেন না, সম্ভবত তা বুঝেই রাজীবকে সংগঠন ঢেলে সাজার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। দলের শাখা সংগঠনগুলিতে নতুন মুখ আনতেও বলেছেন। এক বিধায়কের মতে, “নেত্রী বুঝতেই পারছেন যে স্থানীয় স্তরে নেতাদের সীমাহীন দুর্নীতি আর ঔদ্ধত্য মানুষ মেনে নেবে না। এখন তাই নতুন মুখ এনে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন।”
ভোটের ফল বেরনোর পরেই জেলা সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তকে সরিয়ে নদিয়াকে কৃষ্ণনগর ও রানাঘাট সাংগঠনিক জেলায় ভেঙে দিয়েছিলেন মমতা। কৃষ্ণনগর জেলা সভাপতি মহুয়া মৈত্র দিল্লিতে থাকায় বৈঠকে থাকতে পারেননি। তাঁর প্রসঙ্গে নেত্রী বলেন, মহুয়া এখন দিল্লিতেই বেশি সময় দেবেন। রানাঘাটের সভাপতি, বর্ষীয়ান নেতা শঙ্কর সিংহকে উদ্দেশ্ করে মমতা বলেন, “আপনার মতো মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। অনেক আশা ছিল। ফল ভাল হল না কেন?” শঙ্কর খুব সংক্ষেপে জানান, এর পিছনে অনেক কারণ আছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি মানুষের আস্থা থাকলেও এলাকার নেতাদের অহংঙ্কার আর দুর্ব্যবহারই দায়ী।
লোকসভা ভোটে কৃষ্ণনগর পুর এলাকায় দলের শোচনীয় ফলের জন্য প্রাক্তন পুরপ্রধান অসীম সাহাকেও মৃদু ভর্ৎসনা করেছেন মমতা। রাজীবকে কৃষ্ণনগরের ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে গিয়ে সভা করতে বলেন তিনি। কৃষ্ণনগর সাংগঠনিক জেলায় বিধায়কদের নিয়ে ‘কোর কমিটি’ গঠন করার নির্দেশও দেন। কৃষ্ণগঞ্জে কেন ব্লক সভাপতি নেই, তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশও করেন মমতা। প্রাক্তন জেলা সভাপতি বলার চেষ্টা করেন, কৃষ্ণগঞ্জের প্রাক্তন বিধায়ক সত্যজিৎ বিশ্বাস খুন হওয়ার পরে সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি। কিন্তু তাতে বিশেষ চিঁড়ে ভেজেনি। সত্যজিৎ তৃণমূলের জেলা যুব সভাপতিও ছিলেন। জেলার সংগঠন ভাগ করার পরে কৃষ্ণনগরের যুব সভাপতি নির্বাচন করা হয়েছে। কিন্তু রানাঘাটের পদ এখনও ফাঁকা। দ্রুত কাউকে মনোনীত করতে বলেন মমতা। সত্যজিতের স্ত্রী, রানাঘাট কেন্দ্রে পরাজিত তৃণমূল প্রার্থী রূপালী বিশ্বাসকে মহিলা সংগঠনে জায়গা দেওয়ার নির্দেশও দেন। নবদ্বীপের বিধায়ক পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা অসুস্থ, কিন্তু বাসে-ট্রেনে যাতায়াত করেন। তাঁকে দল থেকে তাকে গাড়ি দেওয়ার কথা বলেন মমতা।
তৃণমূল সূত্রের দাবি, কারও কোনও অভিযোগ থাকলে তা লিখিত আকারে শঙ্কর সিংহের হাতে দিতে বলেছেন মমতা। শঙ্কর সেটা তাঁর হাতে পৌঁছে দেবেন। জেলা নেতাদের একাংশের দাবি, জেলার সাংগঠনিক ক্ষমতা যে শঙ্করের হাতেই যেতে চলেছে, সেই ইঙ্গিত কার্যত স্পষ্ট। লোকসভা ভোটে কোন-কোন নেতা বিজেপির থেকে টাকা নিয়েছেন তা-ও তিনি শঙ্করকে দেখতে বলেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy