Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

পান খেয়ে সোনার লবঙ্গ ছুড়ে দিতেন জামাই রাজা

সেই রাজা নেই, রাজত্বও নেই। থেকে গিয়েছে কেবল রক্তে মিশে থাকা বনেদিয়ানা আর রাজবাড়ির গল্পকথা। রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে কী ভাবে জামাইষষ্ঠী পালন হত, তা ইতিহাস বইয়ে থাকে না। নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে মহা আড়ম্বরে জামাইষষ্ঠী পালনের অনেক স্মৃতি কিন্তু এখনও রয়ে গিয়েছে।

প্রস্তুতি সারা। শনিবার কৃষ্ণনগরে ছবিটি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।

প্রস্তুতি সারা। শনিবার কৃষ্ণনগরে ছবিটি তুলেছেন সুদীপ ভট্টাচার্য।

নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ২৪ মে ২০১৫ ০০:২২
Share: Save:

সেই রাজা নেই, রাজত্বও নেই। থেকে গিয়েছে কেবল রক্তে মিশে থাকা বনেদিয়ানা আর রাজবাড়ির গল্পকথা।

রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের আমলে কী ভাবে জামাইষষ্ঠী পালন হত, তা ইতিহাস বইয়ে থাকে না। নদিয়ার কৃষ্ণনগর রাজবাড়িতে মহা আড়ম্বরে জামাইষষ্ঠী পালনের অনেক স্মৃতি কিন্তু এখনও রয়ে গিয়েছে।

এক সময়ে কৃষ্ণচন্দ্রের পরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা ছিল অনেক রাজ পরিবারের কাছেই গর্বের বিষয় ছিল। ফলে রাজবাড়ির অধিকাংশ মেয়েরই বিয়ে হত সম্ভ্রান্ত পরিবারে। কাজেই জামাইরা যখন ষষ্ঠী করতে আসতেন, আপ্যায়নের জাঁকজমকও হত সেই বহরে।

কৃষ্ণচন্দ্রের অধস্তন সপ্তম পুরুষ ক্ষৌনীশচন্দ্রের অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী জ্যোতির্ময়ী দীর্ঘদিন রাজপরিবারের প্রধান ছিলেন। তাঁদের বড় মেয়ে জ্যোৎস্নাময়ীর স্বামী রাধিকারঞ্জন চক্রবর্তী ছিলেন হেতমপুরের রাজা। ছোটমেয়ে পূর্ণিমাদেবীর স্বামী ছিলেন কালাজ্বরের ওষুধের আবিষ্কারক ইউ এন ব্রহ্মচারীর ছোট ছেলে নির্মল ব্রহ্মচারী। রাজবাড়ির বধূ অমৃতা রায় জানান, এমন নামী-দামি জামাইদের মান রাখতে কার্যত পয়লা বৈশাখ থেকেই তাঁর শুরু হয়ে যেত। ভোজের আয়োজন তো বটেই। পোলাও এবং কষা মাংস ছিল বাঁধা। তবে তার চেয়েও বড় কথা ছিল উপহার। অমৃতা দেবী বলেন, “জ্যোতির্ময়ী দেবীর আমল পর্যন্ত জামাইদের মূল্যবান সামগ্রী যেমন রত্ন, অলঙ্কার, মহার্ঘ্য পোশাক উপহার দেওয়া হত।”

ঠাটবাটে জামাইরাও কম যেতেন না। ক্ষিতীশচন্দ্র ও কৃষ্ণনন্দিনীর মেয়ে অন্নপূর্ণার স্বামী হৃষিকেষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বৈঁচির রাজা। তাঁর ছিল পানের নেশা। নানা রকম মশলা দিয়ে সাজা পান ঘন-ঘন খেতেন। সে কালে সাজা পানের খিলি লবঙ্গ দিয়ে গেঁথে রাখার চল ছিল। কিন্তু বৈঁচির রাজার খিলিতে গাঁথা থাকত সোনার লবঙ্গ। পান খাওয়ার আগে সেই সোনার লবঙ্গ পানের তিনি খিলি থেকে খুলে ছুড়ে দিতেন। আর রাজবাড়ির ছোটরা এ দিক ও দিক পড়ে থাকা সেই সব সোনার লবঙ্গ কুড়িয়ে নিত।

হাতে টানা পাখা, সিংহদরজা, তিন মহলা প্রাসাদ নিয়ে হাওড়ার আন্দুল রাজবাড়ি এখন ভগ্নপ্রায়। পুরনো দিনের গল্পগুলো শুধু রয়ে গিয়েছে। পরিবারের সদস্য অরুণাভ মিত্র জানান বেশ কয়েক দিন আগে থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়ে যেত। তিন জন হালুইকর ছিলেন। জামাইষষ্ঠী ছিল তাঁদের পরীক্ষার দিন। জামাইরা খেয়ে খুশি না হলে চাকরি থেকে ছুটি! সকালে ষষ্ঠীর সময়ে অবশ্য চিঁড়ে-মুড়কি, আম-কলা, দই-মিষ্টি দিয়েই প্রাতরাশ হত। তার পরে শুরু হত গান-বাজনা। তারই আম-কাঁঠাল-লিচু খাওয়া। দুপুরের পাতে ভাত, মাছের মাথা দিয়ে সোনামুগের ডাল, দু’তিন রকমের সব্জি, চিংড়ি, পাবদা, ভেটকি, দেশি হাঁসের ডিমের কা‌লিয়া, পাঁঠার মাংস, চার-পাঁচ রকম মিষ্টি ও দই। সেই সব দিন ভাগীরথীর গর্ভে তলিয়ে গিয়েছে।

মুর্শিদাবাদে লালগোলা রাজবাড়ির জামাইষষ্ঠী আবার শুধু পরিবারের উৎসব ছিল না। ছিল তল্লাটের ২৫-৩০টি গ্রামের ‘বৃক্ষ উৎসব’।

বন্ধু রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীকে লেখা চিঠিতে লালগোলার ‘দানবীর’ রাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রায়ের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কলকাতার বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ভবন নির্মাণে দান, বিদ্যাসাগরের নিজস্ব গ্রন্থালয় নিলাম হওয়া থেকে বাঁচানো, আর্থিক অনটনের সময়ে বিশ্বভারতীর পাশে দাঁড়ানো— অনেক কীর্তি তাঁর। জেলা জুড়ে পুকুর ও কুয়ো খননের সৌজন্যে মৃত্যুর দেড়শো বছর পরেও তিনি ‘পানিপাঁড়ে’ নামে পরিচিত। তাঁদের পরিবারের জামাইষষ্ঠীও যে কিছুটা অন্য রকম হবে, তা বলাই বাহুল্য।

আড়াই-তিনশো বছর আগে উত্তর প্রদেশের গাজিপুর থেকে এসে লালগোলায় বসতি গড়েছিলেন রায় পরিবারের পূর্বপুরুষেরা। কালক্রমে তাঁরা বিশাল সম্পত্তির মালিকও হন। কিন্তু বংশরক্ষা হচ্ছিল না। বংশরক্ষার জন্যই যোগীন্দ্রনারায়ণকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল। তাঁর চতুর্থ পুরুষ অতীন্দ্রনারায়ণ রায় ওরফে চন্দনবাবুর মনে পড়ে, ‘‘জামাইষষ্টির দিন সকালে আমরা বাড়ির সবাই দল বেঁধে অদূরে মামারবাড়ি পৌঁছে যেতাম। বাবা-মাও যেতেন। সেখানে ভূরিভোজ সেরে ও নানা উপঢৌকন নিয়ে বাড়ি ফিরতাম। কিন্তু আমাদের কাছে ষষ্ঠী বলতে ছিল আসলে এ দিগড়ের প্রজাদের মধ্যে ফল বিতরণ ও বৃক্ষপূজার পার্বণ।’’

আসলে পুকুর ও কুয়ো খননের পাশাপাশি বৈশাখ-জৈষ্ঠের চাঁদি ফাটা রোদ থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে গ্রামে-গ্রামে বটপাকুড় গাছের গোড়ার চাতাল বাঁধিয়ে দিয়েছিলেন রাজা। সেই সব বৃক্ষকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করত গ্রামের লোকজন। চন্দনবাবু বলেন, ‘‘মিথে পরিণত হওয়া এরকম বটপাকুড়ের সংখ্যা অন্তত ২৫-৩০টি তো বটেই। জামাইষষ্ঠীর দিন সেই সব গাছের পুজো দেওয়ার জন্য ভোরে লালগোলা রাজবাড়ির সামনে লাইন পড়ে যেত।’’ বাঁশের টোকা, ঝুড়ি, কুলো বোঝাই করে ওই প্রজাদের দেওয়া হত আতপ চাল, আম, জাম, লিচু, করমচা, খেজুর, জামরুল। ওই সব ফল নিয়ে গিয়ে প্রজারা জামিদারি এলাকার চাতাল বাঁধানো বটপাকুড় গাছের তলায় আরাধনা করত। সেই পুজোয় শাস্ত্রের নির্দেশ নয়, অন্তরের তাগিদই ছিল বেশি।

রাজবাড়ির চেনা ছাঁদে উৎসব আর জাঁকজমকের পাশে এ এক অন্য ছন্দে জামাইষষ্ঠী উদ্‌যাপনের ইতিহাস।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE