Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

উপনির্বাচনে অন্য ছবি জঙ্গিপুর-ফরাক্কায়

উপনির্বাচনে সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় শিলিগুড়ি, আসানসোল থেকে কৈখালি যখন সারা রাজ্যের নজর কেড়েছে তখন এক মৈত্রীর ভোট দেখল জঙ্গিপুর-সুতি-ফরাক্কা। বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, ইভিএম ভাঙা তো দূর, দিনভর কোথাও প্রার্থীরা খোশ মেজাজে গল্প জুড়লেন, কোথাও বা নেতারা একসঙ্গে বসে চাখলেন চা-মুড়ি-ঘুঘনি!

জঙ্গিপুরের তেঘরি হাইস্কুলে ভোটেকেন্দ্রে আলাপচারিতায় ব্যস্ত তিন প্রার্থী। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

জঙ্গিপুরের তেঘরি হাইস্কুলে ভোটেকেন্দ্রে আলাপচারিতায় ব্যস্ত তিন প্রার্থী। ছবি: অর্কপ্রভ চট্টোপাধ্যায়।

বিমান হাজরা
রঘুনাথগঞ্জ শেষ আপডেট: ০৪ অক্টোবর ২০১৫ ০১:০৫
Share: Save:

উপনির্বাচনে সন্ত্রাসের ভয়াবহতায় শিলিগুড়ি, আসানসোল থেকে কৈখালি যখন সারা রাজ্যের নজর কেড়েছে তখন এক মৈত্রীর ভোট দেখল জঙ্গিপুর-সুতি-ফরাক্কা। বুথ দখল, ছাপ্পা ভোট, ইভিএম ভাঙা তো দূর, দিনভর কোথাও প্রার্থীরা খোশ মেজাজে গল্প জুড়লেন, কোথাও বা নেতারা একসঙ্গে বসে চাখলেন চা-মুড়ি-ঘুঘনি! কোথাও আবার গ্রামের উন্নয়নের স্বার্থে অতীতের তিক্ততা ভুলে সুষ্ঠু ভোটগ্রহণের লক্ষে এক সঙ্গে মাঠে নামলেন সব রাজনৈতিক দল। ভোটদানের হারও ছিল চোখে পড়ার মতো। সব জায়গায় ৮৮ থেকে ৯০ শতাংশের মতো ভোট পড়েছে।

শনিবার সারারাজ্যে ছিল উপনির্বাচন। সেই নির্বাচনের খবর ‘কভার’ করতে গিয়ে ‘শাসক দল’-এর রোষের মুখে পড়েন বিভিন্ন সংবাদমাধ্যেমের সাংবাদিকেরা। মারধর করা হয় তাঁদের। কোথাও ঘুষি মেরে নাক ফাটিয়ে দেওয়া হয়। কোথাও কেড়ে নেওয়া হয় ক্যামেরা। মারধরে জখম কয়েক জন সাংবাদিককে হাসপাতালেও ভর্তি করতে হয়েছে। এই যখন সারা রাজ্যের পরিস্থিতি তখন এক ব্যতিক্রমী ভোটের সাক্ষী রইল জঙ্গিপুর-সুতি-ফরাক্কা। জঙ্গিপুরে তৃণমূল, সিপিএম ও কংগ্রেসের প্রার্থীকে দিনভর এক বেঞ্চের উপর বসে জমিয়ে আড্ডা দিতে দেখা যায়। সুতির আহিরণে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের এক জায়গায় বসে মুড়ি-ঘুঘনি খেলেন। আর ফরাক্কায় হাতে হাত লাগিয়ে ভোটারদের সাহায্য করলেন প্রার্থীরা।

জঙ্গিপুরের তেঘরি হাইস্কুলে গ্রাম পঞ্চায়েতের ৫ নম্বর গ্রামসভার নির্বাচনে এ বারের সিপিএম প্রার্থী মুসলেমা বিবি। ২০১৩ সালের নির্বাচনে এই কেন্দ্রে জয়ী হন মুসলেমারই খুড়শাশুড়ি সিপিএমেরই রেহেনা বিবি। এ দিন ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেল ভোটারদের ঘিরে নেতাদের ব্যস্ততা তুঙ্গে। কিন্তু সে দিকে নজর নেই প্রার্থীদের! আপন মনে গল্প করে চলেছেন সিপিএমের মুসলেমা বিবি, তৃণমূলের নাজমা বিবি ও কংগ্রেসের চেনবানু বিবি। একই পাড়ার তিন বধূ কোনও কালেই রাজনীতির ছায়া মাড়াননি। মুসলেমার স্বামী পেশায় রাজমিস্ত্রি। তিনি বলেন, ‘‘১৬ জনের যৌথ পরিবার বলেই ভোটের প্রচারে সমস্যা হয়নি। সকালেই বেরিয়েছি আজ। বাড়িতে দুই ছেলেমেয়ে রয়েছে। জায়েরাই সামলাচ্ছে বাড়ির রান্নাবান্না।’’

উচ্চ মাধ্যমিক পাশ নাজমার স্বামীর ব্যবসা রয়েছে। দুই ছেলেমেয়ের মধ্যে মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। তিনি বলেন, ‘‘নিজেই রান্নাবান্না ঘর সামলাই। আজ সকালে রান্না সেরে বেরিয়েছি।’’ চেনবানুর স্বামী প্রাক্তন কংগ্রেস প্রধান। ভোটে দাঁড়াতে হবে বলে মাস খানেকের চেষ্টায় নিজের নাম সই করতে শিখেছেন। এ দিকে, ভোটের দিনে একসঙ্গে এ ভাবে তিন প্রার্থীকে জমিয়ে আড্ডা দিতে দেখে ভ্রু কুঁচকেছেন অনেকেই। তবে সে দিকে খেয়াল নেই কারও।

তৃণমূলের নাজমার কথায়, ‘‘এমন খোলামেলা আড্ডার সুযোগ তো সচরাচর হয় না। তাই আড্ডাটা ভাঙতে চাইছি না।’’ সিপিএমের মুসলেমা বলছেন, ‘‘যেই জিতুক মিষ্টিটা তো পাচ্ছিই। ভোটের কথা তাই ভাবছিই না। গ্রামের তিন বৌ একসঙ্গে হলে কথা কি ফুরোতে চায়!’’ মাথা নেড়ে সায় দেন চেনবানু। তিনি বলেন, ‘‘আমরা ঠিক করেছিলাম যে যাকে খুশি ভোট দিক। যতক্ষণ ভোট চলবে চুটিয়ে আড্ডা দেব। একসঙ্গে আড্ডা দিতে দেখলে কেউ গোলমাল পাকাতে পারবে না। পারেওনি।’’

একই চিত্র সুতির আহিরণের জেহেলিনগরে। গ্রামে ঢোকার মুখে এক জায়গায় বসে তৃণমূল, সিপিএম ও কংগ্রেসের নেতারা। তাঁদের ঘিরে রয়েছেন শ’খানেক সমর্থক। তৃণমূলের জেলা সম্পাদক বাপি ঘোষ মুড়ির ঠোঙা বানাচ্ছেন। একজনের হাতে ঘুগনির বালতি। ঘুগনি মুড়ি খেতে খেতে ব্লক কংগ্রেসের সভাপতি রজত দাস আপন মনেই বলছিলেন, ‘‘পেট শান্ত তো মন শান্ত।’’ তারপর সিপিএম স্থানীয় সম্পাদক অসিত দাসকে লক্ষ করে হাঁক পেড়ে বলেন, ‘‘কী অসিতদা চলবে নাকি?’’ সিপিএম স্থানীয় সম্পাদক অসিত দাস হাত তুললেন, ‘‘না না থাক। কর্মীরা আছে একসঙ্গেই যা হয় মুখে দিয়ে নেব।’’ আহিরণ পঞ্চায়েতে ক্ষমতায় তৃণমূল, কংগ্রেসের সমর্থনে। এই আসনের হার জিত বদলাবে না তাতে। কিন্তু তফসিলি মহিলা সংরক্ষিত এই আসনে যিনি জিতবেন পঞ্চায়েতে একমাত্র সংরক্ষিত প্রার্থী হিসেবে তিনি হবেন উপপ্রধান। এ দিন ওই কেন্দ্রে ৯০ শতাংশ ছাড়ায় ভোটদানের হার।

মাস আট আগে ফরাক্কায় খুন হয়েছিলেন পঞ্চায়েত সমিতির সিপিএম সদস্য হাসমত শেখ। অভিযোগের তির ছিল কংগ্রেসের দিকে। এ বারে সেই আসনে সিপিএম প্রার্থী হাসমত পুত্র আখিরুল শেখ। লড়াই মূলত তৃণমূলের সইবুর রহমান ও কংগ্রেসের ওলিউল্লা শেখের সঙ্গে। তিন জনেরই বাড়ি জোড়পুকুরিয়া গ্রামে। গ্রামের একই প্রাথমিক স্কুলে চারটি ও পাশের গ্রাম বটতলার একটি বুথে দিনভর ভোটগ্রহণে তদারকি করলেন তিন প্রার্থীই। ভোট হল নির্বিঘ্নেই। আখিরুলের কথায়, ‘‘সকলেই চান বাবার খুনিরা শাস্তি পাক। কিন্তু কেউই চাই না রাজনৈতিক গণ্ডগোলের জেরে গ্রামের উন্নয়ন ব্যাহত হোক। তিন প্রার্থীই চেয়েছি গ্রামবাসীরা যাতে শান্তিতে ভোট দিতে পারে তা নিশ্চিত করতে। সকলে মিলে সেটাই করেছি।’’ তৃণমূলের সইবুর বা কংগ্রেসের ওলিউলেরও সাফ কথা, ‘‘অতীত ভুলতে চাই আমরা। চাই শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। তার ফল, অভিযোগ ছাড়াই নির্বিঘ্নে ভোট দিয়েছেন গ্রামের ৮৮ শতাংশ মানুষ।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Peaceful Jangipur Farakka election by poll
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE