বৈষ্ণব দর্শনে রাসের যে ব্যাখ্যাই দেওয়া হোক, নবদ্বীপের ভজনকুঠিতে যে ভাবেই রাস পূর্ণিমা উদ্যাপন হোক না কেন বৈষ্ণবশাস্ত্র মতে গুপ্ত বৃন্দাবন নবদ্বীপে রাসে আসে অন্য ভাবে। পূর্ণিমার ভরা চাঁদের রাতে বিশুদ্ধ তন্ত্র মতে শতাধিক শক্তিমূর্তির সাড়ম্বর পুজো। সঙ্গে রাজকীয় পৃষ্ঠ পোষকতায় বেড়ে ওঠা উৎসবের এক উচ্চকিত দামাল উদযাপন। নবদ্বীপের রাস উৎসব বৈষ্ণবীয় ভাগবৎ ভাবনায় সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং বৈষ্ণব, শাক্ত, শৈব, দেবদেবী থেকে মঙ্গলকাব্য বা নানা লোকায়ত দেবদেবীর বিচিত্র মূর্তির সাড়ম্বর পুজোয় নবদ্বীপের রাস এক অভিনব ধর্মীয় সমন্বয় ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আদতে রাস বৈষ্ণবদের অন্যতম প্রিয় এক উৎসব। প্রাচীনকালে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের আগে সে উৎসবের রূপ ছিল ভিন্ন। মঠ, মন্দির, ভজনকুঠিতে পালিত হত রাস। চৈতন্য পরবর্তী কালে অন্য বৈষ্ণবীয় উৎসবের মতো রাসেও আমূল পরিবর্তন ঘটে। নবদ্বীপে বৈষ্ণব মন্দিরে বড় বড় পটে রাধাকৃষ্ণের মূর্তি এঁকে, ঘূর্ণায়মান চাকার মাঝে যুগলমূর্তি বসিয়ে, মশাল জ্বেলে কীর্তন সহযোগে সাড়ম্বরে রাস উদযাপন হত। নবদ্বীপে রাস পূর্ণিমার অন্য নাম ‘পটপূর্ণিমা’।
প্রথাগত এই বৈষ্ণবীয় ধারা থেকে এক স্বতন্ত্র রাসের সূচনা হয় নবদ্বীপে মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের রাজত্বে। শক্তির উপাসক কৃষ্ণচন্দ্র তাঁর রাজত্বে শুদ্ধাচারে শক্তিপুজোর প্রসার ঘটাতে রাসপূর্ণিমাকে বেছে নিলেন।
রাজানুগ্রহে অচিরেই সেই উৎসব ছাপিয়ে যায় বৈষ্ণবীয় রাসকে। উৎসব যাতে ষোড়শপচারে হতে পারে সে জন্য রাজকোষ থেকে অর্থ বরাদ্দ করেন নদিয়ারাজ। কৃষ্ণচন্দ্রের হাতে নবদ্বীপের রাস উৎসবের যখন পর্বান্তর ঘটছে, তখন তন্ত্রোক্ত শক্তি মূর্তি দিয়েই সূচনা হয়েছিল সেই নতুন পর্বের। নবদ্বীপে তখন স্মৃতি এবং নব্যন্যায়ের সেরা পণ্ডিতদের বাস।
মহালয়ার সকালে পিতৃতর্পণ সেরে এই সব পণ্ডিতরা চলে যেতেন শিষ্যবাড়ি দুর্গাপুজো করতে। দীপান্বিতার পরে বাড়ি ফিরে সাড়ম্বরে নিজ নিজ গৃহদেবতা বা ইষ্টদেবীর পুজো করতেন কার্তিকের রাসপূর্ণিমা তিথিতে। তবে সে পুজোয় মূর্তি থাকত না। পল্লির মানুষ জন প্রসাদের নিমন্ত্রণ পেতেন। এক দিকে, বৈষ্ণব মঠে রাস উৎসব, অন্য দিকে শহরের ধনী পণ্ডিতদের বাড়ির উৎসব। দুয়ে মিলে সেকালের নবদ্বীপ রাসের সময় জমজমাট হয়ে থাকত।
মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেই উৎসব মুখর নবদ্বীপকেই বাছলেন রাসের চরিত্র বদলানোর জন্য। কৃষ্ণচন্দ্র ঘোষণা করেন, যিনি ঘটের বদলে মাটির মূর্তি গড়ে পুজো করবেন তিনি রাজানুগ্রহ পাবেন। এই ঘোষণায় প্রথম সাড়া দেন ভারত বিখ্যাত নৈয়ায়িক শঙ্করনাথ তর্কবাগীশ। ইনি কৃষ্ণচন্দ্রের সভাপণ্ডিত ছিলেন। নবদ্বীপের দেয়ারাপাড়ায় তিনিই প্রথম আলোকনাথ কালীর মূর্তি নির্মাণ করে পুজো করেন। লোক মুখে এলানিয়া বা অ্যালানে কালী নামে পরিচিত এই প্রতিমাই নবদ্বীপের রাসের প্রথম প্রতিমা। সময়টা ১৭৫২ থেকে ৫৬-র মধ্যবর্তী কোনও বছর। পরের বছর শিতিকণ্ঠ বাচস্পতি রাসে তাঁর আরাধ্য দেবীর ‘শবশিবা’, তার পরের বছর ভুবনমোহন বিদ্যারত্ন ‘মুক্তকেশী’ মাতার মূর্তি গড়ে পুজো শুরু করেন।
এ ভাবে শুরু থেকেই নবদ্বীপের রাসে নিজের পছন্দ মতো মৃন্ময় মূর্তি গড়ে পুজোর প্রচলন হয়। মূর্তি বৈচিত্র্যের সেই শুরু। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নিজে পোড়ামাতলায় আসতেন এবং শোভাযাত্রা করে তাঁর সামনে দিয়ে প্রতিমা নিয়ে যাওয়া হত। রাজা প্রতিমার শ্রেষ্ঠত্ব বিচার করে মৃৎশিল্পীদের পুরস্কৃত করতেন। সেই ধারা মেনে রাসের পরদিন আড়ং হয়।
বাংলার বিখ্যাত ধর্মীয় উৎসবগুলি সাধারণ ভাবে কোনও দেবতাকে ঘিরে আবর্তিত হয়। কিন্তু, নবদ্বীপের রাসে কয়েক’শো বিচিত্র দেবী প্রতিমা। যেগুলির নির্মাণ ভাবনা থেকে রূপকল্প, ধ্যানমন্ত্র থেকে পুজোপদ্ধতি সবই ভিন্ন। একই উৎসবে এত রকমের দেবদেবীর পুজো ভূ-ভারতে আর কোথাও হয় না। বাংলার অন্য উৎসবের সঙ্গে নবদ্বীপের রাসের মূল পার্থক্য এখানেই। নবদ্বীপের রাস ভারতের আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির এক আশ্চর্য মহামিলন। সূচনায় বিরোধিতা থাকলেও পরবর্তীতে নবদ্বীপের রাস এক আশ্চর্য ধর্মীয় সমন্বয়ের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে, যা নজিরবিহীন।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)