Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
gouri ghosh

Gouri Ghosh: আলোক-ধ্বনিময় মঞ্চে কোথায় গৌরীর মগ্নতা?

গৌরী ঘোষেরা যখন অনুষঙ্গ ছাড়াই সিদ্ধি পেয়েছিলেন, এখন এত আড়ম্বর লাগছে কেন?

পার্থ ঘোষ এবং গৌরী ঘোষ।

পার্থ ঘোষ এবং গৌরী ঘোষ।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায় 
শেষ আপডেট: ২৮ অগস্ট ২০২১ ০৫:২৫
Share: Save:

গায়ে জড়ানো জামদানি শাড়ির আঁচল। তিনি কখনও কুন্তী, কখনও বাহারুদ্দিনের মেয়ের মরণ ঘুম ভাঙাতে চাওয়া আর্তনাদ। কখনও সত্যকামের জননী জবালার কাছে ফিরে আসার ঘোর লাগা সন্ধ্যাপথ। প্রতিটি উচ্চারিত শব্দের পাশের শূন্যতায় তিনি অবলীলায় তৈরি করে যাচ্ছেন এক শব্দহীন আবহ। তুঙ্গ উচ্চারণ মুহূর্তেও এক জোড়া সরু চুড়ি পরা হাতে বারবার টেনে নিচ্ছেন সেই জামদানি আঁচল।

সদ্যপ্রয়াত গৌরী ঘোষ প্রসঙ্গে এই সময়ের আবৃত্তিকার আকাশ দত্ত বলছেন, “ওঁর শব্দের উচ্চারণ প্রবাহে এক হিরণ্ময় রোদ্দুর। বাংলা ভাষার যে ধ্বনি-নির্মাণকে বহুমাত্রিক আবৃত্তিক কাঠামোয় পেলাম আমরা, তা গৌরীদির এক অবিনশ্বর যাত্রার রেখাচিত্র। তাঁর উচ্চারণ নিখুঁত ব্যাকরণ-নির্ভর অথচ জীবনের তাপে প্রাণবান।” কৃষ্ণনাগরিক আকাশের মতে, “আকাশবাণীর শব্দ উচ্চারণের নিজস্ব রীতি অথবা রেকর্ড ও মঞ্চের পরিবর্তিত প্রেক্ষিতে তিনি আশ্চর্য ভাবে স্বতন্ত্র ও মৌলিক।”

তাঁর সামনে বসে কখনও আবৃত্তি শেখেননি, অথচ বিনীতা সেন নিজের কবিতা জীবন নির্মাণ করেছেন গৌরীর অনুসরণে। রাণাঘাটের এই প্রবীণ আবৃত্তিশিল্পীর কাছে গৌরী ছিলেন একলব্যের দ্রোণাচার্য। ষাট পেরোনো শিল্পী বলেন, “আমার শুরুটা হয়েছিল কাজী সব্যসাচীর কাছে। তারপর কবে যে গৌরীদির কণ্ঠের জাদুতে সম্মোহিত হলাম আজ আর মনে নেই। এক সময়ে দেখলাম, আমি তাঁরই আবৃত্তির অনুসারী হয়ে উঠেছি।” তাঁর মনে পড়ে, “কাজী সব্যসাচী বলতেন, ‘কোনও দিন আবহ নিবি না। তাহলে কন্ঠ মাধুর্য হারাবে।’ গৌরী ঘোষ ঠিক সেটাই করে দেখালেন গোটা জীবন ধরে। কবিতাও যে বসে এক-দু’ঘণ্টা টানা শোনা যায়, এটা পার্থ ঘোষ এবং গৌরী ঘোষ প্রমাণ করেছিলেন।”

এক সময়ে আবৃত্তিকারের ডাক পড়ত দু’টি অনুষ্ঠানের মাঝে স্বাদবদল করতে। মঞ্চ প্রস্তুতির ফাঁকে। পর্দার সামনে দাঁড়িয়ে মাইক্রোফোন নিয়ে কবিতা বলছেন কেউ, পিছনে সশব্দে মঞ্চ তৈরি হচ্ছে। তখনও ‘বাচিকশিল্পী’ শব্দের ব্যবহার শুরু হয়নি। ঠিক এই জায়গা থেকে গৌরী-পার্থ আবৃত্তিকে স্বতন্ত্র পরিবেশনার মর্যাদা দিলেন।

এখন আবৃত্তির পরিসর বিরাট। মাইক্রোফোনের সামনে নিস্তরঙ্গ দাঁড়িয়ে শুধু কণ্ঠ দিয়ে অনুভবে বিচিত্র তরঙ্গ তোলার দিন শেষ। আবহ, আলো থেকে মঞ্চ, পোশাক সব মিলিয়ে এখন আবৃত্তি। বিপুল শ্রোতা তার। শিল্পীর সংখ্যাও ততোধিক। কিন্তু গৌরী ঘোষেরা যখন অনুষঙ্গ ছাড়াই সিদ্ধি পেয়েছিলেন, এখন এত আড়ম্বর লাগছে কেন?

নদিয়ার আবৃত্তি মঞ্চে চেনামুখ, পড়শি কাটোয়ার বাসিন্দা নন্দন সিংহ বলছেন, “আবৃত্তি শিল্পে অনেক চমক এখন। গৌরীদি বলতেন, উচ্চারণ করবে অনুভব থেকে, সহজ সাবলীল ভাবে, তা হলে কিচ্ছুটির প্রয়োজন হবে না। কিন্তু উপলব্ধির ওই স্তরে যেতে পারে ক’জন?” বিনীতা মনে করেন, “এখন অনেকেই কিছু না বুঝে আবৃত্তি করেন। ফলে নিহিতার্থ প্রকাশ পায় না। অনুভবের প্রশ্নে নাই বা গেলাম। ভিতরের দৈন্য ঢাকতেই এত আলো, সঙ্গত, সাজের আয়োজন।”

তবে নবীন প্রজন্মের আকাশের মতে, “বদলে যাওয়া সময়ে পেশাগত দায়বদ্ধতায় আমাদের আলো, ধ্বনি বা পোশাকের সঙ্গত ব্যবহার করতে হয় এবং তা অবশ্যই যুক্তিযুক্ত। তবু গৌরী ঘোষ এক উদাহরণ ও আশ্রয়, যেখানে শব্দের মহিমান্বিত উচ্চারণ, শিল্পীকে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে নিরাভরণ সৌম্যতার আত্মবিশ্বাসে। ”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

gouri ghosh
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE