গাঙ্গেয় সমতলে এমন উঁচু মাটির ঢিপি, ইটভাটা ছাড়া সচরাচর চোখে পড়ে না। ভূ-প্রকৃতিগত কারণেই থাকার কথাও নয়। অথচ দক্ষিণ নদিয়ার গাংনাপুরের দেবগ্রাম পঞ্চায়তের ঝোপজঙ্গলের মধ্যে এমন মাটির ঢিপি একাধিক। ওই জঙ্গলের ভেতরে আছে মাটির চওড়া পাঁচিল আর গভীর পরিখা দিয়ে ঘেরা গড়। স্থানীয় মানুষেরা বলেন এ সবই নাকি দেবল রাজার।
কিন্তু কে এই দেবল রাজা? তাঁর কোনও হদিস ইতিহাস বইয়ের পাতায় মেলে না। যদিও নদিয়ার রানাঘাট সংলগ্ন দেবগ্রাম, নাসেরকুলি, আনুলিয়া, গুড়পাড়ায় চাষ করতে বা পুকুর খুঁড়তে গিয়ে কিংবা বাড়ির ভিত কাটতে গিয়ে মাটির তলা থেকে হামেশাই পাওয়া যায় প্রাচীন মৃৎপাত্র, অলঙ্কার, মূর্তি। তবে কি ওই জঙ্গলঘেরা বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাপা পড়ে আছে কোনও হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্যতা?
এই উত্তর এক দশকেরও বেশী সময় ধরে খুঁজে চলেছেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। ভূ-প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক, রানাঘাটের বাসিন্দা বিশ্বজিৎ রায়ের লেখায় দেবল রাজার গড় হয়েছে ‘দেবলগড়’। তিনি জানান, দেবলগড় অনেকটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে আছে। নদিয়ার রানাঘাট, চাকদহ ব্লক এবং পাশের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার কিছু অংশ জুড়ে দেবলগড়। এখানে রয়েছে মাটির তৈরি এক গড়ের বিরাট ধ্বংসাবশেষ। যার কেন্দ্রীয় অংশ বা গড়ের আয়তন এক বর্গ কিলোমিটারের বেশি।
বিশ্বজিৎ বলেন, “দেবলগড় এমন একটি নদী-বন্দর কেন্দ্রিক সভ্যতা যা অন্তত দু’হাজার বছরের প্রাচীন। ওখান থেকে এখনও পর্যন্ত কুষাণ যুগ, গুপ্ত যুগের মৃৎ পাত্র, মুদ্রা এবং পাল-সেন যুগের নানা নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এখানে গুপ্ত পরবর্তী যুগে অর্থাৎ পাল-সেন যুগের অনেক আগে থেকেই সভ্যতা চূড়ান্ত বিকশিত হয়েছিল। যদিও তার সূত্রপাত আরও প্রাচীন।” তাঁর কথায়, দেবলগড় প্রাচীন বঙ্গের অন্যতম প্রধান নদী মরালীর পাশে গড়ে উঠেছিল। মরালী গঙ্গার সঙ্গে যুক্ত ছিল। তখন অবশ্য গঙ্গার গতিপথ অনেকটাই ভিন্ন ছিল। সে কালের আর একটি নদী নির্ভর প্রত্নক্ষেত্র চন্দ্রকেতুগড় থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দেবলগড়। তিনি বলেন, “দক্ষিণবঙ্গ হয়ে সমগ্র বঙ্গের যোগাযোগ, বাণিজ্য এবং ধর্মাচরণের ক্ষেত্রে দেবলগড় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র। অথচ দুর্ভাগ্যের বিষয় বাংলার ইতিহাসে তা অনালোচিত, অবহেলিত।”
তিনি আরও জানিয়েছেন, পুরাতত্ত্ববিদ রজত সান্যালের নেতৃত্বে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতত্ত্ব বিভাগ সম্প্রতি দেবলগড়ে সপ্তাহ ব্যাপী সমীক্ষার কাজ করেছে। তাঁরা খুব তাড়াতাড়ি দেবলগড় উৎখননের কাজ শুরু করবেন বলেই তাঁদের আশা।
পুরাতত্ত্ববিদ রূপেন্দ্রকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এই এলাকায় আদি মধ্যযুগ থেকে বেশ কয়েক শতক জুড়ে জনবসতি ছিল বলে প্রাথমিক ভাবে অনুমান করা যায়। এই এলাকা থেকে চন্দ্রকেতুগড় খুব দূরের নয়। তাই নিম্ন বঙ্গে আদি মধ্যযুগে সমৃদ্ধ সভ্যতার অনুমান উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে দেবল রাজার গড় এলাকাটি সম্পর্কে ভাল করে জানতে প্রথা মেনে খননকার্য করতে হবে। তা হলে আমাদের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের অনেকটা অংশ আমরা জানতে পারব।’’
বিশ্বজিতের কথায় দেবলগড় নিয়ে প্রথম উৎসাহ দেখিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ পুরাতত্ত্ব বিভাগের প্রথম অধিকর্তা পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত। তিনি ১৯৭০-৭১ সালে দেবলগড়ে আসেন। দীর্ঘ দিন ঘাঁটি গেড়ে গোটা এলাকা খুঁটিয়ে অনুসন্ধান করেন, স্থানীয় মানুষদের সঙ্গে কথা বলেন, তথ্য সংগ্রহ এবং নমুনা সংগ্রহ করেন। তিনিই প্রথম বলেছিলেন অবিলম্বে এই এলাকার উৎখনন হওয়া দরকার। তাঁর আক্ষেপ “কিন্তু পরেশচন্দ্র সব কিছু সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার পরে এই বিষয়ে আশ্চর্যজনক ভাবে নীরব হয়ে যান। তাঁর অনুসন্ধান কোথাও প্রকাশিত বা প্রদর্শিত হয়নি।”
২০১৭ সালে এখানে স্থাপিত হয় ‘দেবগ্রাম দেবলরাজা পুরাতত্ত্ব ও লোকসংস্কৃতি সঙ্ঘ।’ স্থানীয় মানুষদের সাহায্যে তৈরি হয়েছে একটি সংগ্রহশালা।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)