পাঁচ জন ছাত্রকে নিয়ে শুরু হয়েছিল ‘অনির্বাণ গাছের ইস্কুল’। চার বছর পেরিয়ে ফরাক্কার জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় সেই ‘গাছের ইস্কুলে’র ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা এখন ১৩০। শান্তিনিকেতনের ছাত্র অংশুমান ঠাকুরের ভাবনাতেই গড়ে ওঠে এই স্কুল। ফরাক্কার একটি সরকারি কলেজের বাংলার শিক্ষক অংশুমান। ঝাড়খণ্ড সীমানায় ফরাক্কার শ্যামলাপুরের ওই এলাকায় বিদ্যালয় চালাতে তিনি নিজেই গড়ে তুলেছেন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সম্পাদকও অংশুমান নিজে।
২০২১ সালে হাজার পাঁচেক টাকা নিয়ে শুরু করেছিলেন স্কুল তৈরির কাজ। তারপর একে একে হাত বাড়িয়ে দেন শ্যামলাপুর ও তার আশপাশের তরুণ-তরুণীরা। বাদল রাজোয়ার, ম্যামুয়াল মুর্মু, মনোজ রাজোয়ার, শান্তি টুডু, সারিতা সরেনের মতো আট জন ছিলেন সঙ্গী। তাঁদের তিন জন স্নাতক, বাকিরা উচ্চ মাধ্যমিক পাশ, দু’জন মাধ্যমিক উত্তীর্ণ। নার্সারি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হয় এই স্কুলে। গাছের ছায়ায় খেজুর গাছের পাতার চাটাই পেতে বসে পড়ুয়ারা।
অংশুমান বলেন, “গ্রামে সরকারি প্রাথমিক স্কুল রয়েছে। কিন্তু দিনের সেই সময়ে ছেলেরা কেউ যায় মাঠে, কেউ বা খেলে বেড়ায়, কেউ বা মাছ ধরে। সংসারের টানাপড়েনে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা ওদের শৈশব। তাই স্কুলের গণ্ডি মারায় না বহু শিশু। তাদের শিক্ষার অঙ্গনে টেনে আনার লক্ষ্যেই খোলা আকাশ আর গাছের নীচে এই স্কুল গড়ে তোলা। ওদের ভাষা ও উচ্চারণকে মান্যতা দিয়ে নামের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে ‘ইস্কুল’ কথাটি। ওরা বাংলায় পড়ে, বাংলায় লেখে। কিন্তু কথা বলে ওদের আঞ্চলিক ভাষায়। সে ভাষা বোঝার সুবিধার জন্য স্কুলের আট জন শিক্ষকের মধ্যে ছ’জন জনজাতি গোষ্ঠীর।
রাজেন মুর্মু এই গাছতলার ইস্কুল থেকেৃ পড়াশোনা করে বাহাদুরপুর হাই স্কুল থেকে ২০২৩ সালে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন। এখন এই স্কুলেইশিক্ষকতা করছেন।
এই ‘ইস্কুল’ চলে সকাল সাড়ে ছ’টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত। তাই স্কুলে উপস্থিতির হারও প্রায় ৮০ শতাংশেরও বেশি। পড়ুয়াদের জন্য স্কুলশেষে খাবারের আয়োজনও করা হয় প্রতি দিন, জানান অংশুমান। তিনি বলেন, “গাছতলায় বৃষ্টি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সমস্যা তো থাকেই। তাই গ্রামেই গড়ে ওঠা সরকারি কমিউনিটি হলের দু’টি ঘরের একটিতে তখন আশ্রয় নিতে হয়। সেখানেই গড়ে তোলা হয়েছে একটি গ্রন্থাগার।” গাছের স্কুলের দেখাশোনা করেন শিক্ষক বিপ্লব মণ্ডল। শ্যামলাপুরেই তাঁর বাড়ি। শিক্ষকেরা সকলেই স্বেচ্ছাসেবী, যৎসামান্য সাম্মানিকে কাজ করেন।
কিন্তু বই, পড়ুয়াদের খাবার, শিক্ষকদের সাম্মানিকের জন্য অর্থ আসে কোথা থেকে? বিপ্লব বলেন, “সমাজমাধ্যমে গাছের ইস্কুলের কথা পড়ে অনেকেই সাহায্যের হাত বাড়িয়েছেন। অনেকেই দু’জন, এক জন করে পড়ুয়ার দায়িত্ব নিয়ে তাদের খরচ জোগান। এ বছর একটি বহুজাতিক সংস্থা থেকে সাহায্য পেয়েছি। গ্রন্থাগারের বইগুলি আসে বিভিন্ন সংস্থা থেকে। সেই বইই দেওয়া হয় ছাত্র-ছাত্রীদের।” চার বছর ধরে এ ভাবেই চলছে ফরাক্কার প্রত্যন্ত গ্রামের ‘অনির্বাণ গাছের ইস্কুল’।
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)