E-Paper

চোখের জলেই শ্রাদ্ধ ঈশিতার

গীতাপাঠ আর খোলের শব্দ ভেদ করে মায়ের ডুকরে কান্নার শব্দ আছড়ে পড়ল বাইরে। পথচলতি মানুষের কানে। অনেকে থমকে দাঁড়ালেন। বাইরের ফটকের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কেউ কেউ দেখার চেষ্টা করলেন ভিতরটা।

সুস্মিত হালদার

শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২৫ ০৮:৫৩
শ্রাদ্ধের কাজ করছেন ঈশিতার বাবা। পাশে রাখা মেয়ের ছবি। শুক্রবার কৃষ্ণনগরে।

শ্রাদ্ধের কাজ করছেন ঈশিতার বাবা। পাশে রাখা মেয়ের ছবি। শুক্রবার কৃষ্ণনগরে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

পরলোকিক ক্রিয়া শেষ। সামনে দাঁড়িয়ে‌ থাকা বড় মেয়ের কোলে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়লেন ঈশিতার মা। তখনও একটানা সুরে গীতাপাঠ করছেন পুরোহিত। সঙ্গে টানা খোল বাজিয়ে চলেছেন মাঝবয়সি এক জন।

গীতাপাঠ আর খোলের শব্দ ভেদ করে মায়ের ডুকরে কান্নার শব্দ আছড়ে পড়ল বাইরে। পথচলতি মানুষের কানে। অনেকে থমকে দাঁড়ালেন। বাইরের ফটকের গ্রিলের ফাঁক দিয়ে কেউ কেউ দেখার চেষ্টা করলেন ভিতরটা।

শুক্রবার সকাল থেকেই মুখ ভার করে ছিল আকাশ। মাঝে এক পশলা ঝিরঝিরে বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে। বছর উনিশের মেয়েটার অপঘাতের শোক ছেয়ে রয়েছে ভিজে বাতাসে। তারই মধ্যে শ্রাদ্ধের আয়োজন সেরে রেখেছিলেন পরিজনেরা। ঈশিতার দাদুর ঘরের সামনেই পরলোকিক ক্রিয়ার আয়োজন। চেয়ারের উপরে তার ছবি রেখে তাতে যত্ন করে মালা দেওয়া হয়েছে। সেই ছবির দিকে তাকিয়ে মাঝেমধ্যেই ডুকরে উঠছিলেন এক প্রৌঢ়া— ঈশিতার ঠাকুমা।

যন্ত্রের মতো পুরোহিতের বলে দেওয়া মন্ত্র উচ্চারণ করে গিয়েছেন ঈশিতার বাবা দুলাল মল্লিক। পৃথিবীর কোনও কিছুই যেন তখন স্পর্শ করছে না তাঁকে। পাশেই ঈশিতার মা মন্ত্রোচ্চারণ করতে-করতে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠছেন বার বার। কিন্তু সে সব কিছুই যেন তাঁর নজরে আসছে না। তিনি স্থির তাকিয়ে রয়েছেন মেয়ের ছবিটার দিকে।

একটা সময় পুরোহিত বলেন, “মেয়ে নয় এখন মা, মেয়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করুন। কল্পনা করুন, মা একটা গোলকের ভিতরে দেবিরূপে আছেন।” পুরোহিতের কথা শোনার পর আস্তে আস্তে চোখ দুটো বন্ধ করেন দুলাল। কে জানে, হয়তো জন্মের পর প্রথম দেখা মেয়ের মুখটা মনে করার চেষ্টা করেন তিনি। তখনই সমস্ত সংযম, সমস্ত আবেগের বাঁধ ভেঙে যায়। তিনিও ডুকরে ওঠেন।

শেষযাত্রার দিনটির মতো এ দিনও ভাইয়ের হাত শক্ত করে ধরে থাকতে দেখা গেল ঈশিতার দিদি দীপান্বিতাকে। প্রথম দিন থেকেই দীপান্বিতা পাথরের মতো স্থির। নিজের যাবতীয় শোক, বোন হারানোর যন্ত্রণা ভিতরে চেপে রেখে বাবা-মা আর ভাইকে আগলে রাখার কাজটা করে চলেছেন তিনিই। চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে আসতে দেননি।

শ্রাদ্ধের কাজ।

শ্রাদ্ধের কাজ। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য।

এ দিন কিন্তু আর শেষ পর্যন্ত নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না দীপান্বিতা। ভাইয়ের হাত ধরে বেশ কিছুক্ষণ বোনের ছবির দিকে স্থির তাকিয়ে ছিলেন তিনি। তার পর মাটিতে বসে পড়ে খবরের কাগজের উপর তিল ঢেলে বাছতে থাকেন। কিন্তু পারলৌকিক কাজের শেষে মা কুসুম তাঁকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়তেই আর নিজেকে সামলে রাখতে পারেননি দীপান্বিতা। মায়ের পিঠে হাত হোলাতে বোলাতে ফুঁপিয়ে ওঠেন তিনিও। শ্রাদ্ধের আয়োজনের মধ্যে স্বযত্নে রাখা ছিল এক জোড়া দুধ-সাদা হিলতোলা জুতো। সাদা জুতো ঈশিতার বড় পছন্দ ছিল। কাজের শেষে দুলালের বুক ঠেলে উঠে আসে স্বগত হাহাকার, “আমার চেয়ে দুর্ভাগা আর কে আছে!”

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

police investigation Krishnanagar

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy