Advertisement
E-Paper

ফেসবুকের ‘ওয়াল’ কাড়ছে ভোট-যুদ্ধের চেনা দেওয়াল

রঙিন নামাবলি গায়ে বিলকুল পাল্টে গিয়েছে পাড়ার লোনাধরা, স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালগুলো। বাদ যায়নি বেপাড়ার বা গুরুত্বপূর্ণ পথের মোড়ের ঝাঁ চকচকে দেওয়ালও। সারা বছর যে সব জায়গা নামি দামি ব্র্যান্ডের নজর কাড়া বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ হয়ে থাকে, সেখানে এখন রঙিন হরফের বাহারি খেলা। চেনা অচেনা কত নাম, চিহ্ন। কিন্তু সে দিন এখন গিয়েছে। অনেক প্রার্থীই ফেসবুকে বেশি স্বচ্ছন্দ। তাঁরা ফেসবুকে প্রচারও করছেন।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০১৫ ০১:০৭
নবদ্বীপের একটি দেওয়ালে ভোটের প্রচার। —নিজস্ব চিত্র।

নবদ্বীপের একটি দেওয়ালে ভোটের প্রচার। —নিজস্ব চিত্র।

রঙিন নামাবলি গায়ে বিলকুল পাল্টে গিয়েছে পাড়ার লোনাধরা, স্যাঁতস্যাঁতে দেওয়ালগুলো। বাদ যায়নি বেপাড়ার বা গুরুত্বপূর্ণ পথের মোড়ের ঝাঁ চকচকে দেওয়ালও। সারা বছর যে সব জায়গা নামি দামি ব্র্যান্ডের নজর কাড়া বিজ্ঞাপনে ছয়লাপ হয়ে থাকে, সেখানে এখন রঙিন হরফের বাহারি খেলা। চেনা অচেনা কত নাম, চিহ্ন। কিন্তু সে দিন এখন গিয়েছে। অনেক প্রার্থীই ফেসবুকে বেশি স্বচ্ছন্দ। তাঁরা ফেসবুকে প্রচারও করছেন। তেমনই এক প্রার্থী বললেন, ‘‘সেটা ছিল টেস্ট ম্যাচের যুগ। তখন দেওয়ালে লেখা হত। এখন আইপিএলের সময়। এখন ফেসবুকেই বেশি সময় দেন ভোটারেরা। তাই ফেসবুকের ওয়ালেই আমরা নজর রাখছি।’’ আর এক দলের প্রার্থীরও বক্তব্য, ‘‘পুরভোট মানে শহরের ভোটার। তাই ফেসবুকেই বেশি প্রচার করছি। দেওয়ালে প্রচার করলে বরং দূষণের অভিযোগ শুনতে হচ্ছে।’’

ভোটের আগে সত্যিই দেওয়াল যেন ছিল জমাখরচের খাতা। একদলের প্রত্যয়ী ঘোষণা, গত পাঁচ বছরের কী কী করেছেন। আর বিপক্ষদল সেখানে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চান কী কী পারেনি ‘অপদার্থ’ শাসক দল। ভোট প্রচারে দেওয়াল চিরকালই খুব গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। একটা সময় ছিল যখন ছড়া-ছবি-চিহ্ন-কার্টুনে দেওয়াল প্রচার রীতিমতো শিল্পের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল। জয়দেব থেকে জীবনানন্দ কাকে না পাওয়া যেত দেওয়াল প্রচারে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাওয়া আধুনিক প্রচার মাধ্যমের ভিড়ে মনে হয়, দেওয়ালের বুঝি দিন গিয়াছে। পুরভোটের প্রচারে দেওয়াল-ছড়ায় এবার যেন ভাঁটার টান। নিছক গদ্যে ভরা কেজো লেখায় ভরা দেওয়ালে মন ভরছে না রসিক জনের।

এবারে পুরযুদ্ধে নবদ্বীপের দেওয়ালে ছড়ার অভাব অনেককেই হতাশ করেছে। হাতে গোনা কয়েকটি ওয়ার্ডে মিলছে ছড়ার দেখা। তবে সে সব ছড়ার মান আহামরি কিছু নয়। যেমন পুরসভার একুশ নম্বর ওয়ার্ডে চোখে পড়ছে সিপিএমের দেওয়াল লিখন—‘করলে তুমি ডেলোর কেলো। মদন মুকুল মাল কামালো। বলছে এখন চোরের মা। আমি কিছু জানি না।’ আবার তৃণমূলের প্রচারে শহরের বিভিন্ন দেওয়ালে দেখা যাচ্ছে কয়েকটি ‘কমন’ ছড়া—‘হাতে নয়,কাস্তেতে নয়। ভোট নয় পদ্মফুলে। মা বোনেরা জোট বেঁধেছে, সব ভোট তৃণমূলে।’ কিংবা ‘বাম শাসনে শুধুই ভাঁওতা আর ভুল। উন্নয়ন মানেই তৃণমূল।’ নবদ্বীপের চারিচারা পাড়ায় পনেরো নম্বর ওয়ার্ডে সিপিএম প্রার্থীর সমর্থনে লেখা হয়েছে ‘চা মিষ্টি তেলেভাজা, বাংলা হবে শিল্পে তাজা। পরিবর্তনের কালো রাত, দিদির সফর সঙ্গী জালিয়াত। ত্রিফলা থেকে লেক মল, তৃণমূল চোরের দল।’

ব্যঙ্গ চিত্র চোখে পড়েছে পুরসভার চোদ্দ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের দেওয়াল প্রচারে। নীতিকথার গল্প ‘আঙুর ফল টকের’ অনুকরণে ছবিতে দেখানো হয়েছে গাছের আঙুর ফলের নীচে বিজেপি বেশি শেয়াল বসে বলছে “আমার সাম্প্রদায়িক দোসর, বন্ধু ম্যাও সিপিএম ভাই--আমায় তুলে ধর আমি আঙুর ফলটা খাই।”

গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে দাদাঠাকুরের হাতে প্রচারের নতুন মাধ্যম হিসেবে ভোটের ছড়ার আবির্ভাব। তারপর বহু বছর ধরে এই দেওয়াল ছড়া ভোট প্রচারে ভোটারের মন মজিয়েছে। ন’য়ের দশকে দূরদর্শন সহ অন্য বৈদ্যুতিন মাধ্যমের দাপট বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দেওয়ালের দেওয়ালে পিঠ ঠেকা শুরু। দেওয়াল প্রচারের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকেছে ইন্টারনেট ও সোশ্যাল নেটওয়ার্ক সাইটের বাড়বাড়ন্ত। তাই পাঁচ বছর আগেও ভোট প্রচারে দেওয়ালে জয় গোস্বামীর চেনা কবিতার লাইন থেকে মান্না দে’র জনপ্রিয় গানের কলি ঘুরে ফিরে এসেছে প্রচারের মাধ্যম হয়ে। যেমন মালতিবালা বালিকা বিদ্যালয় কবিতার অনুকরণে ‘ ফুলদিদি ফুলদিদি তোমার বাড়ি যাবো। ফুলদিদি তুমি কি আর আমার কথা ভাবো। ফুলদিদি বলেছিলে চাকরি দেবে রেলে। চাকরি দেবে টিএমসির মিছিল সভায় গেলে। মিছিল হল, মিটিং হল, চাকরি হল কই।’ অথবা কার্টুন ছবিতে দেখা গিয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বাড়িতে বসে। বাড়ির টালির চালে লেখা কালিঘাটের মন্দির। সামনের রাস্তা দিয়ে খোল করতাল বাজিয়ে দুহাত তুলে বুদ্ধ-বিমান গাইতে গাইতে আসছেন ‘আমায় একটু জায়গা দাও, মায়ের মন্দিরে বসি।’

কিন্তু যতদিন যাচ্ছে ভোটের প্রচারে দেওয়াল পিছিয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন ? উত্তরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা নানা কারণের কথা বললেও একটা বিষয়ে সবাই এক মত—দেওয়াল লেখার তুলনায় অনেক নির্ঝঞ্ঝাট ফ্লেক্স প্রচার।

নবদ্বীপ শহর তৃণমূলের সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ পাল বলেন, “ দুটো কারণে দেওয়াল পিছিয়ে পড়ছে। এক দেওয়াল লেখার জন্য এত বিধি নিষেধ যে সব দলই উৎসাহ হারাচ্ছে। এবং দেওয়াল লেখার লোকের সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। অন্য দিকে প্রচারে ছড়া বা ব্যঙ্গচিত্র আঁকতে গেলে আলাদা মনন এবং মেধার দরকার হয়। এখন তেমন লোক কোথায়।” ফলে ভোট প্রচারে নজরকাড়া দেওয়াল চোখে পড়ে না। পাশাপাশি ডিজিটাল প্রিন্টিং এর ফ্লেক্সে এমন সুন্দর চোখ ধাঁধানো ডিজাইন হচ্ছে যে, সাদামাটা রঙের দেওয়াল আর টানে না ভোটারকে। বিজেপি নবদ্বীপ পুরভোটে দেওয়াল লিখবে না আগেই বলে দিয়েছে। কারণ হিসেবে বিজেপির নদিয়া জেলা সহ সভাপতি এবং নবদ্বীপ পুরসভার ২৪ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী জীবনকৃষ্ণ সেন বলেন, “দেওয়াল লিখন মানে এক ধরনের দূষণ। দৃশ্যদূষণ। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন স্বচ্ছ ভারত অভিযান করছেন দূষণমুক্ত ভারত গড়তে তখন আমরা কেন দৃশ্যদূষণ ঘটাবো? বরং আমরা ফ্লেক্স, ব্যানারে প্রচার করব। যেগুলি ভোট মিটে গেলেই সরিয়ে দেব। পাশাপাশি দেওয়াল দখল ঘিরে অহেতুক অশান্তি আমরা চাইছি না।”

প্রচার যুদ্ধে অভিনবত্ব এনেছেন তৃণমূলের মিহিরকান্তি পাল। তিনি কোন রাজনৈতিক তরজায় না মেতে পুরসভার আট নম্বর ওয়ার্ডের দেওয়াল ভরে দিয়েছেন মনীষীদের বাণীতে। সেখানে চৈতন্যদেব, বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ কেউ বাদ নেই। তাঁর কথায় “ভোট একদিন মিটে যাবে। কিন্তু পথের পাশে এইসব মহাপুরুষদের কথাগুলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনে পাথেয় হয়ে থাকবে।”

অন্য দিকে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য এবং নবদ্বীপ পুরভোটের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুমিত বিশ্বাস বলেন, “লিখব কী করে? মানুষ ভয়ে আমাদের অনুমতি দেয় না। কী জানি, যদি তৃণমূলের কুনজরে পড়ি। পাশাপাশি নতুন প্রজন্ম কিন্তু দেওয়ালের থেকে কম্পিউটার বা মোবাইলের ওয়ালেই বেশি স্বচ্ছন্দ। ফলে দেওয়াল প্রচার গুরুত্ব হারাচ্ছে।”

Wall campaigning Nabadwip Municipal election Trinamool Tmc CPM Bjp Congress Mamata Bandopadhyay Job Cartoon Facebook Debashis Bandopadhyay
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy