Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

করিমপুরের ধমনীতে এখনও নাট্যচর্চার নীলরক্ত

বছর কয়েক আগের কথা। পৌষের কনকনে ঠান্ডায় করিমপুর নাট্য সংস্থার নিজস্ব মাঠে অস্থায়ী মঞ্চে চলছে বাংলাদেশ থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রযোজনা ‘আমিনা সুন্দরী’। মঞ্চের সামনে কয়েক হাজার দর্শক। মাঝে একবার বিরতির সময়টুকু ছাড়া গোটা নাটক চলাকালীন দর্শকদের মধ্যে ছিল পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। নাটক শেষ। মঞ্চের উপর এক এক করে উঠে এসেছেন ওপার বাংলার নাট্যশিল্পীরা।

২০১৪ সালে অভিনীত ওই সংস্থার নাটক ‘ফিরে এসো প্রেম’

২০১৪ সালে অভিনীত ওই সংস্থার নাটক ‘ফিরে এসো প্রেম’

কল্লোল প্রামাণিক
করিমপুর শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:৪৪
Share: Save:

বছর কয়েক আগের কথা। পৌষের কনকনে ঠান্ডায় করিমপুর নাট্য সংস্থার নিজস্ব মাঠে অস্থায়ী মঞ্চে চলছে বাংলাদেশ থিয়েটার আর্ট ইউনিটের প্রযোজনা ‘আমিনা সুন্দরী’। মঞ্চের সামনে কয়েক হাজার দর্শক। মাঝে একবার বিরতির সময়টুকু ছাড়া গোটা নাটক চলাকালীন দর্শকদের মধ্যে ছিল পিন পড়ার নিস্তব্ধতা। নাটক শেষ। মঞ্চের উপর এক এক করে উঠে এসেছেন ওপার বাংলার নাট্যশিল্পীরা। হাততালি দিতে দিতে উঠে দাঁড়িয়ে তাঁদের কুর্নিশ জানালেন এ পার বাংলার দর্শকরা। হিমেল সেই রাতে কাঁটাতার, সীমান্তের রাঙা চোখ ভুলে কয়েক মুহূর্তের জন্য মিলেমিশে একাকার হয়ে গিয়েছিল দুই বাংলা। ওই নাটকের নির্দেশক রোকেয়া রফিক বিবি বলেছিলেন, “বহু জায়গায় আমরা নাটক করতে গিয়েছি। কিন্তু করিমপুরের মতো এত ভাল নাটকের দর্শক আমরা খুব কমই দেখেছি।” শুধু রোকেয়া নন, সীমান্তের এই এলাকার দর্শকদের প্রশংসা করে গিয়েছেন প্রয়াত রমাপ্রসাদ বণিক, স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত, সব্যসাচী চক্রবর্তীর মতো ব্যক্তিত্বরাও।

করিমপুরের এই নাট্যচর্চার ইতিহাস বেশ পুরনো। করিমপুরের নাট্যকর্মী কল্যাণ চট্টোপাধ্যায় জানান, স্বাধীনতার কয়েক বছর পরেই ১৯৫৩ সালে যুবক সঙ্ঘ নামে করিমপুরে একটি নাট্য সংস্থা গড়ে ওঠে। সেই সময় ওই সংস্থা প্রথম মঞ্চস্থ করেন সুখেন্দুশেখর বাগচির লেখা নাটক ‘জমিদার নন্দিনী’। তারপর থেকে টানা দশ বছর তারা বহু নাটক মঞ্চস্থ করে। ১৯৬৩ সালে যুবক সঙ্ঘ ভেঙে তৈরি হয় বীণাপানি অপেরা ও আনন্দমঠ অপেরা। তাদের মঞ্চস্থ করা নাটক, ‘চাষার মেয়ে’ তখন বেশ নাম করেছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে করিমপুরের আনন্দপল্লি বয়েজ ক্লাবের সদস্যরা মঞ্চস্থ করেছিল ‘বিশ বছর আগে’ নামে একটি নাটক। প্রতি বছর ওই ক্লাবের সদস্যরা দুই থেকে তিনটি নাটক মঞ্চস্থ করতেন। তখন আনন্দপল্লি বয়েজ ক্লাবের ছেলেদের বৈঠক বসত প্রয়াত গণেশ মণ্ডলের বাড়িতে। গণেশবাবুর মা প্রয়াত শান্তিলতাদেবী নাটকের ব্যাপারে খুব উৎসাহী ছিলেন। করিমপুরে যখন বিদ্যুৎ আসেনি, নাটকের পোশাক ভাড়া পাওয়া যেত না তখন বিকল্প ব্যবস্থা করে নাটক মঞ্চস্থ করার পরামর্শ দিতেন শান্তিলতাদেবীই।

১৯৬৯-৭০ সালে নাট্যকার-অভিনেতা-পরিচালক সনৎ চৌধুরী তত্ত্বাবধানে তৈরি হয় ‘বহুরূপী’ নাট্য সংস্থা। সেই সময় সনৎবাবুর লেখা ‘রক্তে ভেজা মাটি’, কিরণ মৈত্রের ‘বারো ঘণ্টা’, ‘নাম নেই’, রতন ঘোষের ‘সিঁড়ি’ শৈলেন গুহ নিয়োগীর ‘উত্তাল তরঙ্গ’, উৎপল দত্তের ‘ফেরারি ফৌজ’ সাড়া ফেলে দিয়েছিল সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন নাট্যমঞ্চে। সেই সময়েই হাসপাতালপাড়ার স্বামীজি স্মৃতি সঙ্ঘ ও লক্ষ্মীপাড়ার আমরা ক’জন নামে তেরী হয়েছিল দু’টি নাট্যমঞ্চ। করিমপুরের আর এক নাট্যকর্মী শিশির দাস জানান, ১৯৭৯ সালে স্থানীয় বাসিন্দা কানাই সাহা, নারায়ণ মণ্ডল, মানিক বিশ্বাস, নারায়ণচন্দ্র ঘোষ ও অন্যান্য বেশ কয়েকজনের উদ্যোগে তৈরি হয়েছিল মিলনতীর্থ নামে এক নাট্যদল। মিলনতীর্থ তৈরি হওয়ার আগে থেকেই ওই নাট্যদলের সদস্যরা অরুণ চট্টোপাধ্যায়ের নির্দেশনায় নাটক করতেন। সেই সময় তাঁরা মঞ্চস্থ করেছিলেন সমর দত্তের ‘জিগরুদানু ব্রুনো’, অরুণ মুখোপাধ্যায়ের ‘মারীচ সংবাদ’, রাধারমণ ঘোষের ‘সূর্য নেই, স্বপ্ন আছে’-র মতো বেশ কয়েকটি নাটক।

আশির দশকেই তরুণ সঙ্ঘ ব্যায়ামাগার কোনও নাট্যদল না হলেও ‘ইতিকথা’, ‘জামগাছ’ এর মতো বেশ কয়েকটি নাটক করে সাড়া ফেলে দিয়েছিল। ১৯৯০-৯১ সালে ছন্নছাড়া নাট্যগোষ্ঠী ‘বেকার’ নামে একটি নাটক মঞ্চস্থ করেছিল। ১৯৮৫ সালে গড়ে ওঠে গণনাট্য সঙ্ঘের করিমপুর শাখা দিশারী সাংস্কৃতিক দল। দিশারী ‘শতাব্দীর ডাক’, ‘বাজার রাতের গল্প চিনে রাখা’-র মতো নাটক মঞ্চস্থ করেছে। আশির দশকে শুরু হল ছাত্র-যুব উৎসব। বিভিন্ন ধরনের খেলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের প্রতিভাকে সুযোগ দিতেই ওই উৎসব। এর মধ্যে চলে এসেছিল নাটকও। তখনই করিমপুর ও লাগোয়া সেনপাড়া, যমশেরপুর, শিকারপুর, দাঁড়েরমাঠ ও সীমান্তের বিভিন্ন গ্রামে নাট্যদল তৈরি হল। দু’একটি দল প্রতি বছর এই উৎসবে নিয়ম করে নাটক করতে শুরু করল। সেই নাট্যগোষ্ঠীগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল মিলন তীর্থ ও দাঁড়েরমাঠ উল্কা নাট্য সংস্থা। সেই সময় সীমান্তের চাষি ও খেতমজুরদের নিয়ে একটি নাটক মঞ্চস্থ করা হয়েছিল।

কল্যাণবাবু জানান, ১৯৮১ সালে তৈরি হয় স্মৃতি সঙ্ঘ নামে একটি নাট্যসংস্থা। ওই সংস্থার পরিচালনায় ও মলয় বিশ্বাসের নির্দেশনায় তখন মঞ্চস্থ হয় ‘ছেঁড়া কাগজ’ ও ‘অচল গয়না’। সেই সময় সীমান্তের ফুলবাড়ি থেকে ব্যবসার প্রয়োজনে করিমপুরে এসেছিলেন নাট্যপ্রেমী প্রলয় চট্টোপাধ্যায়। তাঁর অনুপ্রেরণায় ১৯৮৩ সালে স্মৃতি সঙ্ঘ রূপান্তরিত হয় শরৎ স্মৃতি নাট্য সংস্থায়। সেই সময় গ্রামের চাষিদের নিয়ে নাটক করানোর জন্য কলকাতা থেকে নিয়ে প্রলয়বাবু নিয়ে এসেছিলেন তাঁর নাট্যগুরু সুশান্ত মৈত্রকে। এলাকার বহু নাট্যকর্মীরই দাবি, সুশান্তবাবু ওরফে ‘বুলিদা’র সংস্পর্শে এসে অনেকেই পরবর্তীকালে অসাধারণ অভিনয় করেছেন। এক রকম জোর করে করিমপুরে নিয়ে আসা ‘বুলিদা’র হাত ধরেই মঞ্চস্থ হল রবীন্দ্রনাথের ‘কালের যাত্রা’। অন্য অনেক নাটকের দল নানা ওঠাপড়ায় থেমে গেলেও শরৎ স্মৃতি নাট্য সংস্থা আজও লড়াই করেই টিঁকে রয়েছে। ১৯৮৩ সাল থেকে এখনও পর্যন্ত বহু পূর্ণাঙ্গ, একাঙ্ক ও পথনাটক তারা পরিবেশন করেছে। গত ১৯ বছর থেকে দেশ বিদেশের বিভিন্ন নাট্যদলকে করিমপুরে নিয়ে এসে প্রতিবছর এই সংস্থা নাট্যোৎসবের আয়োজন করে।

শরৎ স্মৃতি নাট্য সংস্থার সম্পাদক দেবপ্রসাদ স্যান্যাল বলেন, “প্রতি বছর কলকাতা, বারাসাত, বহরমপুরের মতো বিভিন্ন জায়গা থেকে নামকরা নাট্যদল আসে। বাংলাদেশের নাট্যদলও যোগ দেয় এই উৎসবে। সংস্থার নিজস্ব মাঠেই অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করে এই উৎসব আয়োজিত হয়। এখানকার নাট্যপ্রেমী দর্শকের সংখ্যা আগের থেকে বহু গুণ বেড়েছে। যাঁরা নাটকের অস্থায়ী প্রেক্ষাগৃহ কানায় কানায় ভরিয়ে তোলেন। তবে অনেক সমস্যা নিয়ে পথ চলছে করিমপুরের নাটক। এখানে কোনও প্রেক্ষাগৃহ নেই। নেই কোনও নাট্যমঞ্চও। বাঁশ কাঠের অস্থায়ী মঞ্চ তৈরি করেই আয়োজন করতে হচ্ছে আন্তর্জাতিক নাট্য উৎসব। ফলে ইচ্ছে থাকলেও এমন পরিস্থিতিতে নাটক মঞ্চস্থ করতে রাজি হচ্ছে না বহু নামকরা দলই। সরকারি সাহায্য পেলে এমন অনেক প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠা যাবে। গতি পাবে করিমপুরের নাটক।”

করিমপুর ১ বিডিও তাপস মুখোপাধ্যায় বলেন, “করিমপুরে বছরভর সংস্কৃতির চর্চা হয়ে থেকে। মুক্তধারা নামে একটি নতুন নাট্যসংস্থা এ বছর তৈরি হয়েছে। করিমপুরে নাটক মঞ্চস্থ করার মতো কোনও প্রেক্ষাগৃহ বা নাট্যমঞ্চ নেই। আগামী দিনে সরকারি ভাবে এ ব্যাপারে সব রকম চেষ্টা করা হবে।”

৭৫ বছর বয়সে আজও অতীতের স্মৃতি একটুও ভুলে যাননি করিমপুরের আর এক নাট্য অভিনেতা অধীর বিশ্বাস। তিনি জানান, তখন অবিভক্ত বাংলাদেশের মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চোয়াডাঙার মতো বিভিন্ন জায়গায় তাঁরা নাটক করতেন। ১৯৫৭ সালে তিনি নবম শ্রেণির ছাত্র। সহপাঠী, পরবর্তীতে বিখ্যাত রাজনীতিবিদ অনিল বিশ্বাস ‘ডাকঘর’ নাটকের অমলের চরিত্রে অভিনয় করে সকলের মন জয় করেছিলেন। ১৯৬০-৬২ সালেও ‘একটি পয়সা’, ‘বুড়ি বালামের তীরে’ কিংবা ‘সিরাজ-উদ-দৌলা’ নামের বহু নাটক মঞ্চস্থ হয়েছিল। সেই সময়ে করিমপুরের ধরণী দত্ত, চিত্ত সাহা, ভীমচন্দ্র স্বর্ণকার বা মধু সাহারা ভাল অভিনেতা হিসাবেই পরিচিত ছিলেন।

সেই নাট্যচর্চার ধারাকে বহন করে নিয়ে যাওয়াটাই করিমপুরের চ্যালেঞ্জ।

কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে
আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর-নদিয়া মুর্শিদাবাদ’।
ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:

www.facebook.com/anandabazar.abp
অথবা চিঠি পাঠান ‘আমার শহর’,
নদিয়া মুর্শিদাবাদ বিভাগ, জেলা দফতর
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

amar shahor kallol pramanik karimpur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE