গরম পোশাকের সম্ভার নিয়ে শহরে হাজির ‘ভুটানি’র দল। বিভিন্ন ঝিলে পরিযায়ী পাখিদের আনাগোনা। শুরু হয়ে গিয়েছে লালবাগকে ঘিরে মুর্শিদাবাদ জেলার পর্যটন মরসুমের কাউন্টডাউন। কিন্তু বহিরাগত পর্যটকরা যে প্রত্যাশা নিয়ে লালবাগ বেড়াতে আসেন, তাঁদের সেই পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্র প্রস্তুতে কোনও মাথাব্যাথাই নেই প্রশাসনের। গা-ছাড়া মনোভাব এতটাই যে সম্প্রতি পর্যটন নিয়ে ডাকা প্রশাসনিক বৈঠকে দেখা গেল না পুলিশ-প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ আধিকারিকদের।
গরহাজিরদের দলে ছিলেন লালবাগের মহকুমাশাসক প্রবীর চট্টোপাধ্যায়, মুর্শিদাবাদ থানার আইসি দেবাশিস চট্টরাজ। এর মধ্যে দেবাশিসবাবু সরাসরিই বলে দেন, “গত বছরের বৈঠকে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু কোনও অজানা কারণে তা কার্যকরী হয়নি। তাই যাইনি।”
তবে, প্রবীরবাবু জানিয়েছেন বহরমপুরে জেলা প্রশাসনের জরুরি বৈঠকে হাজির থাকার জন্য পর্যটন বিষয়ক ওই আলোচনায় থাকতে পারেননি তিনি। তার বদলে ওই বৈঠক পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় লালবাগ মহকুমা প্রশাসনের এক জন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটকে। মহকুমাশাসক বলেন, “বৈঠকে পর্যটকদের স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ উপস্থিত না থাকলেও আইসি-র সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। তিনি শহরের যানজটমুক্ত রাখতে সব রকম সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন।”
জানা গিয়েছে, এই যানজট নিয়েই পুলিশের সঙ্গে নীতিগত বিরোধিতা চলছে ব্যবসায়ীদের। হাজারদুয়ারি লাগোয়া কেল্লা নিজামত চত্বরে পর্যটকদের গাড়ি দাঁড় করানোর বিরোধী মুর্শিদাবাদ থানার পুলিশ। তাদের বক্তব্য, কেল্লা নিজামত চত্বর পর্যন্ত গাড়ি নিয়ে যেতে হলে শহরের বিভিন্ন সঙ্কীর্ণ রাস্তার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। এতে শহর অবরুদ্ধ হয়ে পড়বে। যান চলাচলের পাশাপাশি নাগরিক জীবনও থমকে যাবে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ আধিকারিক বলেন, “কেল্লা নিজামত চত্বর এলাকায় পর্যটকদের কোনও বাস দাঁড় করিয়ে রাখা চলবে না বলে গত বছরের বৈঠকে প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু ব্যবসায়ী সমিতির এক জন প্রতিনিধি ওই প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কোনও কারণ ছাড়াই বাকিরাও তাতেই সায় দেন।” ওই আধিকারিকের প্রস্তাব, “লালবাগ কলেজের উল্টো দিকে মুর্শিদাবাদ জেলা পরিষদের বাসস্ট্যান্ডে পর্যটকদের যানবাহন দাঁড় করিয়ে রাখা হলে শহর যানজট মুক্ত থাকবে। সেক্ষেত্রে বহরমপুর থেকে ভাগীরথীর পাড় ধরে এসে মতিঝিলের রাস্তা দিয়ে এবং চুনাখালি দিক থেকে আসা বিভিন্ন পর্যটকের গাড়িগুলিও সহজে ওই স্ট্যান্ডে রাখা সম্ভব।”
ব্যবসায়ীরা অবশ্য পুলিশের এই প্রস্তাবে আমল দিতে রাজি নন মোটেই। লালবাগ ব্যবসায়ী সমিতির সম্পাদক স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “পর্যটকরা অনেক আগে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে লালবাগ বেড়াতে আসেন। তাঁরা এত দিন জেনে এসেছেন যে কোনও যানবাহন হাজারদুয়ারি পর্যন্ত যায়। আচমকা কয়েক কিমি দূরে শহরের বাইরে যানবাহন রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ভুগতে হবে পর্যটকদের।” তাঁর কথায়, “এমনিতেই সন্ধ্যা হলেই লালবাগ ফাঁকা। তার মধ্যে শহরের বাইরে অন্ধকারের মধ্যে চুরি-ছিনতাই হতে পারে। পুলিশের এক জন অফিসার যা বলবে, তা মেনে নিতে হবে নাকি! পর্যটকদের যানবাহন শহরের মধ্যে এমন কিছু যানজট করবে না।” উল্লেখ্য গত ১৮ নভেম্বরের প্রশাসনিক বৈঠকে কেল্লা নিজামত চত্বরের বিভিন্ন জায়গা পর্যটকদের গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য ব্যবহৃত হবে বলেই ঠিক হয়েছে।
সেই সিদ্ধান্তে সায় থাকুক আর না-থাকুক এই সময়টা শহরকে যানজটমুক্ত রাখার দায় নিয়েছে পুলিশ। কিছুটা দায় নিয়েছেন কংগ্রেস পরিচালিত মুর্শিদাবাদ পুর-কর্তৃপক্ষও। জনবহুল ও ব্যস্ততম শহরের ৮টি মোড়ে পুর-কর্তৃপক্ষ যান নিয়ন্ত্রণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। পুরপ্রধান শম্ভু ঘোষ বলেন, “পর্যটকদের যানবাহন নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরসভার তরফে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক নিয়োগ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গাড়ি নিয়ে শহরে ঢোকার ক্ষেত্রে লালবাগ স্টেশনের পাশ দিয়ে রেজিস্ট্রি অফিস-চকবাজার হয়ে হাজারদুয়ারি চত্বরে পৌঁছনো যাবে। আর বের হওয়ার সময়ে দক্ষিণ দরওয়াজা হয়ে পাঁচরাহা বাজারের রাস্তা দিয়ে তৃতীয় সড়ক ধরে বহরমপুরের রাস্তায় উঠবে। এই যাতায়াতের পথে ৮টি মোড় পড়ছে। প্রতিটি মোড়ে স্বেচ্ছাসেবক থাকবে।”
এ দিকে, পর্যটকদের অসুবিধার বেশ কিছু দিক অনালোচিতই থেকে গিয়েছে এবারের বৈঠকেও। যেমন, লেকটাউনের বাসিন্দা শ্রাবণী বসু মনে করিয়ে দেন, “হাজারদুয়ারি ছাড়া অন্য যে সমস্ত পুরাসম্পদ ছড়িয়ে রয়েছে, সেই সব জায়গায় কোনও মহিলা শৌচালয় নেই। এছাড়াও ভাগীরথীতে নৌকা পরিবহনে নজরদারি চালানো দরকার প্রশাসনের।” এদিকে লালবাগ স্টেশন চত্বরে দাঁড়িয়ে থাকা রিকশা বা টাঙা সঠিক ভাড়া নেয় না বলে অভিযোগ। সেই সঙ্গে এক শ্রেণির হোটেলের গুণগত মানও ভাল নয়। মুর্শিদাবাদ নগর উন্নয়ন কমিটির পক্ষে এ আর খান বলেন, “রাজনীতির কচকচানিতে পর্যটনচিত্রে এখনও মুর্শিদাবাদ উপেক্ষিত রয়ে গেল। শুধু প্রশাসন কেন, পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে জনপ্রতিনিধিদেরও দায় রয়েছে। কিন্তু তাঁদের ভূমিকা অত্যন্ত হতাশজনক। পর্যটন শিল্পের উন্নয়নের বিষয়ে কারও কোনও হেলদোল নেই।”