Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ফিরেই মেয়েকে খুঁজলেন প্রদীপ

বছর তিনেক আগে, জানুয়ারি মাসের হাড় হিম করা এক রাতে তাঁকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দূর, জুতো পড়ার সময়টুকুও দেওয়া হয়নি। বুধবার বেকসুর খালাস পেয়ে ফেরার সময়েও সে স্মৃতি পিছু ছাড়ছিল না প্রদীপ সাহার। তাঁর কথায়, “একদিন বাদে হাজতে কাগজ পড়ে জানতে পেরেছিলাম কেন আমায় গ্রেফতার করা হয়েছে।

মাস্টারমশাইকে ঘিরে উচ্ছ্বাস কুলকামিনী হাইস্কুলের পড়ুয়াদের। —নিজস্ব চিত্র।

মাস্টারমশাইকে ঘিরে উচ্ছ্বাস কুলকামিনী হাইস্কুলের পড়ুয়াদের। —নিজস্ব চিত্র।

দেবাশিস বন্দ্যোপাধ্যায়
নবদ্বীপ শেষ আপডেট: ২৮ নভেম্বর ২০১৪ ০০:৩৯
Share: Save:

বছর তিনেক আগে, জানুয়ারি মাসের হাড় হিম করা এক রাতে তাঁকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। কেন নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দূর, জুতো পড়ার সময়টুকুও দেওয়া হয়নি।

বুধবার বেকসুর খালাস পেয়ে ফেরার সময়েও সে স্মৃতি পিছু ছাড়ছিল না প্রদীপ সাহার। তাঁর কথায়, “একদিন বাদে হাজতে কাগজ পড়ে জানতে পেরেছিলাম কেন আমায় গ্রেফতার করা হয়েছে। আমি নাকি সজল ঘোষের খুনে অভিযুক্ত।” তবে পূর্বস্থলী পৌঁছেই যে অভ্যর্থনা তিনি পেলেন তাতে ৩৪ মাসের আঁধার অধ্যায় অনেকটাই ফিকে। প্রদীপবাবুর কথায়, “পারুলিয়া বাজারে হাজার হাজার মানুষকে দেখে আমি আপ্লুত। মনে হয়েছে, মানুষের জন্য কাজ করলে মানুষ তাকে মনে রাখেন।”

এই ৩৪ মাস বাইরের জগত্‌ তাঁর গ্রেফতার হওয়া নিয়ে তোলপাড় হয়েছে। আদালতে দুঁদে উকিলদের মধ্যে সত্য-মিথ্যার আইনি লড়াই চলেছে। আদালতেও তাঁকে দেখতে চেনা-অচেনা মুখের ভিড় উপচে পড়েছে। আতঙ্ক, উত্‌কণ্ঠা, ভয় যেন ওতপ্রোত হয়ে গিয়েছিল প্রত্যেক দিনের সঙ্গে। বুধবারের ছবিটা ছিল ঠিক উল্টো। তুড়োপাড়ার গলিতে প্রদীপবাবুর ছোট্ট বাড়িতে ভিড় জমিয়েছিলেন তাঁর আত্মীয়-বন্ধু, পড়শিরা। সাড়ে ছ’টা নাগাদ গলির মুখে গাড়ি থেকে নামতেই ভেসে গেলেন অভিনন্দনের জোয়ারে। ৮৩ বছরের শাশুড়ি পূর্ণিমা মৈত্রর পা ছুঁয়ে প্রণাম করে ঘরে ঢুকলেন প্রদীপবাবু। সঙ্গে মা দিপালিদেবী, ছোট ভাই গোপাল এবং বোন অনুরাধা। পিছনে স্ত্রী, শম্পা দেবী। ঘরে ঢুকেই প্রথম খোঁজ মেয়ে পৌলমীর। সে অবশ্য তখন পড়তে গিয়েছিল। এতদিন পরে চেনা বিছানায় বসে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন প্রদীপ সাহা। ছোট বসার ঘরে তখন তিল ধারণের জায়গা নেই। সকলেই জানতে চায় ৩৪ মাসের অভিজ্ঞতা। শম্পাদেবীর দুটো মোবাইল বেজেই চলেছে ক্রমাগত। তিন বছরের অনভ্যাসে মোবাইলে ব্যবহারে একটু ইতস্তত করছিলেন প্রদীপবাবু। ইতিমধ্যে বাড়ি ফিরে এত লোক দেখে একটু জড়োসড়ো কেমিষ্ট্রি অনার্সের প্রথম বর্ষের ছাত্রী পৌলমী। একে একে এলেন দলীয় সহকর্মী, প্রতিবেশিরা। বাইরের অতিথিরা চলে গেলে শুরু হল রাতের খাবারের তোড়জোড়। পাশের বাড়ির প্রভাতবাবু পাঠালেন ইলিশ এবং রুইমাছের পদ। খাওয়ার টেবিলে চলল তুমুল আড্ডা। অনেক দিন পরে রাতে এতক্ষণ জাগলেন মাস্টারমশাই। বৃহস্পতিবার অবশ্য সবার আগে ঘুম থেকে উঠে পড়েন প্রদীপবাবু। এমন নিশ্চিন্ত সকাল এ বাড়িতে বহুদিন পরে এল। চা খেতে খেতে জমে উঠল জেলের সকাল কেমন কাটত, সে গল্প। কোন কাগজ কি লিখল তা পড়তে পড়তেই শুরু হয়ে গেল ফোন আসা। পারুলিয়া থেকে স্কুলের সহকর্মী এবং ছাত্রদের একের পর এক ফোন পেয়ে ঠিক করলেন একবার স্কুলে যাবেন। দুপুরে স্বামীর পছন্দের সব পদ রান্না করেছিলেন শম্পাদেবী। মুগের ডাল, লাউঘণ্ট, ছোলার শাক, ধোকার ডালনা আর ডিমের ওমলেট। ডিমটা নিজেই পাড়ার দোকান থেকে কিনে এনেছিলেন প্রদীপবাবু। ১২টা নাগাদ রওনা হলেন স্কুলে।কুলকামিনী হাইস্কুলে ঢুকতেই ফুল দিয়ে তাঁকে বরণ করলেন শিক্ষিকারা। শুরু হল মিষ্টি খাওয়ানো। পরে কমন রুমে বসে স্কুলের হাল-হকিকত জানতে চাইলেন প্রদীপবাবু। ফেরত আসার আর্জি জানিয়ে স্কুল পরিচালন সমিতিকে চিঠিও দেন। সোয়া বারোটা নাগাদ প্রত্যেক ক্লাসরুমে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে দেখা করেন। পড়ুয়াদের প্রণাম করার ধুম পড়ে যায়। প্রাক্তন ছাত্রেরাও আসে দেখা করতে। প্রদীপবাবু বলেন, “জেলকে সংশোধনাগার বলা হয় বটে, কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা অন্যরকম। সব কথা বলতে পারব না, তাহলে মা খেতে পারবে না। তবে বিশ্বাস ছিল, সত্যের জয় হবে।” ১০ ডিসেম্বর স্কুলের দায়িত্বে ফিরতে পারবেন বলে তাঁর আশা। স্কুল পরিচালন সমিতির সম্পাদক রসময় চক্রবর্তী জানান, খুনের মামলার অভিযোগ ওঠার পরে প্রদীপবাবুকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। আগামী ৪ ডিসেম্বর পরিচালন সমিতির বৈঠক করে সেই সাসপেনশন তুলে নেওয়া হবে এবং স্কুলে যোগ দেওয়ার দিন জানানো হবে। মাস্টারমশাই আসার খবরে ততক্ষণে স্কুলের সামনে মণ্ডলপাড়া, ইস্কুল পাড়া থেকে লোকেরা ভিড় জমাতে শুরু করেছেন। তাঁদের সঙ্গে গ্রামে ঘোরেন প্রদীপবাবু। বলেন, “এলাকার মানুষ দুঃসময়ে পাশে ছিলেন। খোঁজ নিয়ে দেখুন প্রায় সব বাড়ির মহিলারা আমার জন্য মানত করেছেন।” তারপরে পূর্বস্থলীর বাড়ি দক্ষিণপাড়ায় যান। এখনই রাজনীতিতে ফিরবেন কি না জিজ্ঞেস করলে বলেন, “এখনই সক্রিয় রাজনীতিতে ফিরব না। স্কুল, বাড়ির লোকেদের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটাতে চাই।”

(সহ প্রতিবেদন কেদারনাথ ভট্টাচার্য)।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE