পুরসভা এলাকায় পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরির বিষয়ে যে ব্যাপক ছাড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে রাজ্য সরকার তাতে রীতিমতো উদ্বিগ্ন কৃষ্ণনাগরিকরা। তাঁদের দাবি এর ফলে যেমন শহরের প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হবে তেমনই নষ্ট হবে সামাজিক পরিবেশও।
এমনিতেই প্রাচীন এই শহর গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিত ভাবে। রাস্তাঘাট যেমন সংকীর্ণ, নিকাশিব্যবস্থাও তেমনই বেহাল। ফলে এই শহরের বুকে যদি পুরনো বাড়ি ভেঙে একের পর এক বহুতল তৈরি হতে থাকে তাহলে এই শহরের অবস্থা আরও বেহাল হয়ে পড়বে। নিকাশির পাশাপাশি পানীয় জলেরও সমস্যা দেখা দেবে। প্রতিদিন কৃষ্ণনগর পুরসভা মাটির নীচে থেকে প্রায় ৩০ লক্ষ গ্যালন জল তোলে। কৃষ্ণনগর পুরসভার এক কর্মী বলেন, “এমনিতেই প্রতিদিন যে পরিমাণ জল তোলা হচ্ছে তাতে জল-স্তর ক্রমশ নীচের দিকে নামছে। তার উপরে যদি একের পর এক আবাসন তৈরি হতে থাকে তাহলে জল-স্তর আরও নীচে নেমে যাবে। কারণ আইনে যাই থাকুক না কেন বেশিরভাগ আবাসনে সাব মার্সিবল পাম্পের মাধ্যমে মাটির নীচে থেকেই জল তোলা হয়।”
কৃষ্ণনগর হাই স্কুলের প্রধানশিক্ষক উৎপল ভট্টাচার্য বলেন, “এ ভাবে কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে বহুতল তৈরি হতে থাকলে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হবে। হঠাৎ করে শহরে জনসংখ্যা বেড়ে গেলেও দূষণ-সহ নানা রকমের সমস্যা বাড়বে।” পুরনো বাড়ি ভেঙে আবাসন বাড়তে থাকলে পরিষেবা সংক্রান্তও নানা সমস্যা দেখা দেবে। পুরসভার তৃণমূলের এক কাউন্সিলর বলেন, “যদি সত্যি আবাসন তৈরির বিষয়ে এই ধরণের ছাড় দেওয়া হয় তাহলে কিন্তু খুবই বিপদ হবে। এখন যা অবস্থা তাতেই প্রয়োজনীয় পরিষেবা দিতেই আমরা হিমশিম খেয়ে যায়। পরিকাঠামো ও পরিকল্পনা ছাড়া বহুতল বাড়লে সেই সমস্যা আরও বাড়বে। ওই কাউন্সিলরের দাবি, “এমনিতেই শহরের রাস্তা সংকীর্ণ। তার উপরে জায়গার অভাবে রাস্তার উপরেই গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকে। আবাসনের সঙ্গে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাড়িঘোড়া সবই বাড়তে থাকবে। শহরের সংকীর্ণ রাস্তায় আরও যানজট সৃষ্টি হবে।”
পুরসভার এক কর্মী বলেন, “আমাদের শহরের এমন বেশ কিছু এলাকা আছে যেখানে প্রচুর পুরনো বাড়ি আছে। কিন্তু রাস্তা খুবই সংকীর্ণ। সেই রাস্তা দিয়ে দমকলের গাড়ি কিংবা অ্যাম্বুলেন্স কোনওটাই ঢুকতে পারে না।” তিনি বলেন, “পুরনো বাড়ি ভেঙে বহুতল করার বিষয়টি যদি সহজ করে দেওয়া হয় তাহলে কিন্তু ওই সব এলাকায় বহুতল হবেই। সে ক্ষেত্রে আমাদের শহর কিন্তু জতুগৃহ হয়ে পড়বে। কারণ আগুন লাগলে দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে দেখা ছাড়া কার্যত কিছুই করার থাকবে না।” শহরের প্রবীণ শিক্ষক পার্থ স্বর্ণকার বলেন, “এমনিতেই এই শহর থেকে সবুজ হারিয়ে যাচ্ছে। কিছু কিছু পুরনো বাড়িতে যে কটি গাছগাছালি আছে সেটাই শহরের ফুসফুসের কাজ করে। সেই সব বাড়ি ভেঙে যদি বহুতল তৈরি হয় তাহলে সেটুকুও নষ্ট হয়ে যাবে।” তবে সরকারের এই সিদ্ধান্তে সব থেকে চিন্তায় পড়েছেন শহরের পুরনো বাড়ির মালিকেরা। কারণ কৃষ্ণনগর শহরে প্রোমোটার রাজ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের দৃষ্টি ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরের বিভিন্ন পুরনো বাড়ির দিকে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের ফলে এই প্রোমোটার রাজ আরও সক্রিয় হবে বলে মনে করছেন শহরের অনেকেই। যদিও এই প্রসঙ্গে কৃষ্ণনগর পুরসভার পুরপ্রধান তৃণমূলের অসীম সাহা বলেন, “আমরা এখনও সরকারি কোনও নির্দেশ হাতে পাই নি। তাই শুধু মাত্র সংবাদমাধ্যমে খবর দেখে কোনও মন্তব্য করব না।” কিন্তু এর ফলে কি শহরের সার্বিক কোনও ক্ষতি হবে? অসীমবাবু শুধু বলেন, “সরকার যা নির্দেশ দেবে আমরা তা মানতে বাধ্য।”
সরকারের এই সিদ্ধান্তে কৃষ্ণনগরের মতো উদ্বিগ্ন বহরমপুরও। বহরমপুরের প্রবীণ নাগরিক তথা বিশিষ্ট চিকিৎসক উৎপল সিংহ চৌধুরী বলেন, “এমনিতেই পরবর্তী প্রজন্ম পৈতৃক দালান বাড়ি রক্ষণাবেক্ষণ করতে পারছে না। রক্ষণাবেক্ষণ করতে গেলে যে বিরাট খরচের ধাক্কা, তা সামাল দেওয়ার ক্ষমতাও অনেকের নেই। এছাড়াও শরিকি বিবাদ রয়েছে শহরের এমন পুরনো বাড়িগুলির প্রতি শ্যেন দৃষ্টি রয়েছে প্রোমোটারদের।” সরকারের নতুন নগর-নীতি আগামী দিন বহরমপুর শহরকে কংক্রীটের জঙ্গলে পরিণত করবে বলেই আশঙ্কা। কেননা, এখন বহরমপুরে যে হারে বহুতল বাড়ি গড়ে উঠেছে, তাতে শহরের মানচিত্রের বদল ঘটেছে। যেমন, এক সময়ের জলা-জঙ্গলে ভরা ইন্দ্রপ্রস্থ এলাকায় জমি কিনে বাড়ি করার কথা ভাবতে পারতেন না শহরের মধ্যবিত্ত সমাজ। ওই ইন্দ্রপ্রস্থ এলাকার অলিগলি বহুতল বাড়িতে ভরে উঠেছে। দরও আকাশছোঁয়া। বর্তমানে ওই এলাকায় উচ্চবিত্ত লোকজনের বাস। একই ভাবে কাদাই এলাকা, গোরাবাজার এলাকায়, এমনকী মাছমারা বিলের মত জায়গাতেও বহুতল বাড়ি গজিয়ে উঠেছে। ইতিহাস গবেষক খাজিম আহমেদ বলেন, “অল্প আয়াসে ভোট পাওয়া যায়, সেই চেষ্টায় রাজনৈতিক নেতাদের তাড়া করে ফেরে। সরকারের ওই নতুন আইনের ফলে প্রোমোটার রাজ, সিন্ডিকেট রাজ প্রাধান্য পাবেই। এতে সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। তবে নগরায়নেরও প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু সেই নগরায়ণ হোক বাস্তবসম্মত ও বিজ্ঞানসম্মত ভাবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy