Advertisement
E-Paper

মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশ, তবুও উপেক্ষা

বিড়ি শ্রমিকদের দুরাবস্থার প্রতিকার চেয়ে রাজ্য সরকারের কাছে ১৩ দফা সুপারিশ করেছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। তারপরে তিন মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এত দিন পদক্ষেপ তো দূর খোঁজখবরটুকুও নেয়নি রাজ্য। ইতিমধ্যেই শ্রমিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মজুরি বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দফায় দফায় আবেদন জানিয়েছে, ধর্নায় বসেছে, বিক্ষোভও দেখিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। কিন্তু সমস্যা সেই তিমিরে।

বিমান হাজরা

শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০১:২৪
বিপন্ন শৈশব। অরঙ্গাবাদের এক বিড়ি কারখানায়। —­নিজস্ব চিত্র।

বিপন্ন শৈশব। অরঙ্গাবাদের এক বিড়ি কারখানায়। —­নিজস্ব চিত্র।

বিড়ি শ্রমিকদের দুরাবস্থার প্রতিকার চেয়ে রাজ্য সরকারের কাছে ১৩ দফা সুপারিশ করেছিল রাজ্য মানবাধিকার কমিশন। তারপরে তিন মাস পেরিয়ে গিয়েছে। এত দিন পদক্ষেপ তো দূর খোঁজখবরটুকুও নেয়নি রাজ্য। ইতিমধ্যেই শ্রমিকদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মজুরি বৃদ্ধি ইত্যাদি বিষয়ে প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে দফায় দফায় আবেদন জানিয়েছে, ধর্নায় বসেছে, বিক্ষোভও দেখিয়েছে শ্রমিক সংগঠনগুলি। কিন্তু সমস্যা সেই তিমিরে। তাই এ বার মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টকে সামনে রেখে বৃহত্তর আন্দোলনের নামার হুঁশিয়ারি দিল অরঙ্গাবাদের বিরোধী বিড়ি শ্রমিক সংগঠনগুলি। রাজ্য সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে কমিশনের রিপোর্ট ছাপিয়ে শ্রমিকদের মধ্যে বিলি করা হবে বলে হুমকি দেন আইএনটিইউসির বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক বাদশার আলি। দুরাবস্থার কথা মানছেন তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসির মুর্শিদাবাদ জেলার সভাপতি আবু সুফিয়ানও। তিনি বলেন, “মানবাধিকার কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর হলে বিড়ি শিল্পাঞ্চলের চেহারাটাই বদলে যাবে। আমরা এ নিয়ে বিধানসভায় প্রস্তাব আনব। ২ মার্চ রাজ্য শ্রমমন্ত্রীর সঙ্গে যে বৈঠক রয়েছে সেখানেও প্রসঙ্গটি তুলব।”

রাজ্যে প্রায় কুড়ি লক্ষ বিড়ি শ্রমিকের মধ্যে অরঙ্গাবাদ, সুতি, ধুলিয়ান-সহ জঙ্গিপুরের বিড়ি শিল্পাঞ্চলে রয়েছে প্রায় সাত লক্ষ শ্রমিক। ছোটবড় মিলিয়ে ৮২টি বিড়ি কারখানায় দৈনিক ষাট কোটি বিড়ি উৎপাদিত হয়। মূলত দিল্লি, উড়িষ্যা, অন্ধ্রপ্রদেশ-সহ বিভিন্ন রাজ্যে ওই বিড়ি রপ্তানি করা হয়। তাতে বিড়ি কারখানার মালিকেরা লাভবান হলেও শ্রমিকদের ভাগ্যে জোটেনা প্রায় কিছুই। মেলে না ন্যূনতম মজুরিটুকুও। মানবাধিকার কমিশনের পুলিশ সুপার আন্নাপা ই-র নেতৃত্বে মানবাধিকার কমিশনের তিন সদস্যের একটি কমিটি বিড়ি শ্রমিকদের উপরে সমীক্ষা চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায় এলাকার ৯০ শতাংশ বাসিন্দাদের আয়ের একমাত্র উৎস বিড়ি বাঁধাই। শ্রমিকদের বেশিরভাগই মহিলা ও শিশু। ছয় জনের পরিবারের দিনে গড় আয় মাত্র ১৫০ টাকা।

সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, কমবেশি সব কারখানায় শিশুরা শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। আর তামাকের কুপ্রভাবের শিকার সবচেয়ে বেশি এরাই। ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে বেশিরভাগই শিশু ও মহিলা। অথচ বিড়ি শিল্পাঞ্চলে কোনও হাসপাতালই নেই। ধুলিয়ানে একটি কেন্দ্রীয় হাসপাতাল থাকলেও কোনও চিকিৎসক নেই।

শুধু স্বাস্থ্য নয় বেহাল শিক্ষা ব্যবস্থাও। বেশিরভাগ শিশুই স্কুলছুট। তাদেরকে স্কুলে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনও হোলদোল নেই প্রশানের। ফলে শিশুরা স্কুলে না গিয়ে বিড়ি কারখানায় কাজ করে। নিত্য ব্যবহারের জন্য জলের বন্দোবস্থ না থাকায় পুকুরের নোংরা জলই ভরসা বিড়ি শ্রমিকদের। বিড়ি শ্রমিকদের জন্য ৪০ হাজার টাকায় ইন্দিরা আবাস যোজনা ও ২৫০০ টাকায় বৈদ্যুতিকীকরণের সরকারি বন্দোবস্ত থাকলেও অনেকেই সেই সুবিধা থেকে বঞ্চিত।

বিড়ি শ্রমিকদের ওই দুর্দশা লাঘবে মানবাধিকার কমিশন ১৩ দফা সুপারিশ পাঠিয়েছেন রাজ্য সরকারের কাছে। ওই সুপারিশে ন্যূনতম মজুরির প্রচলন, নন-ফরমাল শিক্ষা চালু, সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্প বাস্তবায়ন, সকলকে পরিচয়পত্র দিয়ে ইপিএফের আওতায় আনা, শিশুশ্রম বন্ধে এককালীন অনুদানের বন্দোবস্ত করা, মুন্সি বা মধ্যসত্ত্ব (মিডলম্যান) প্রথার বিলোপ, নিয়মিতভাবে শ্রমিকদের চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা, তামাক নিষিদ্ধকরণে বিড়ি শিল্প সঙ্কটে বিকল্প রুজির সংস্থান ইত্যাদির কথা বলা হয়েছে। রিপোর্টে স্বাক্ষর রয়েছে কমিশনের চেয়ারম্যান নপরাজিত মুখোপাধ্যায় ও সদস্য এমএস দ্বিবেদির। কিন্তু তিন মাসে কেটে গেলেও রাজ্য সরকারের তরফে সুপারিশ কার্যকর করার কোনও উদ্যোগীই লক্ষ্য করা যায়নি।

সিটুর জেলা সভাপতি ও সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ আবুল হাসনাত খান বলেন, “বিড়ি শিল্পাঞ্চলে চিকিৎসা পরিষেবা নেই বললেই চলে। ধুলিয়ানের কেন্দ্রীয় শ্রমিক কল্যাণ হাসপাতালে কার্যত কোনও চিকিৎসাই হয় না। নিমতিতার হাসপাতালটিও অচল। এমনকি জঙ্গিপুর মহকুমা হাসপাতালেও ১০ বছর ধরে কোনও ‘বক্ষ’ বিশেষজ্ঞ নেই।”

আইএনটিইউসির বিড়ি শ্রমিক সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক বাদশার আলি বলেন, “শিক্ষার প্রসারে এই এলাকার ১৪০টি শিশু শ্রমিক বিদ্যালয় থাকলেও ২ বছর থেকে শিক্ষকদের বেতন বন্ধ। বন্ধ ভাতাও।” তিনি জানান, ১৭৩ টাকা সরকার ন্যূনতম মজুরি ধার্য করলেও বিড়ি শ্রমিকরা তা পান না। বাধ্য হয়ে বিড়ি শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক সংগঠনগুলিকে বিড়ি মালিকদের সঙ্গে বোঝাপড়ায় আসতে হয়। তিনি বলেন, “সব জেনেও রাজ্যের কোনও হোলদোল নেই।” সুতির তৃণমূল বিধায়ক ইমানি বিশ্বাস নিজে এক বিড়ি কারখানার মালিক। তিনি বলেন, “বিধায়ক হিসেবে আমি চাই কমিশনের সুপারিশ মানুক রাজ্য সরকার। শ্রমিকদের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন দরকার। তা না হলে বিড়ি শিল্পের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকবে না।”

human rights commission inttuc
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy