Advertisement
E-Paper

যেটা প্লাস, সেটাই আবার মাইনাস

শশীবাবুর ‘সিং’, আর আখতারি গজল! জটিল ধাঁধার জট ছাড়িয়ে রহস্যের সমাধান করে দিয়েছিলেন ফেলু মিত্তির। তাঁকে এখন একটিবার জঙ্গিপুরে নিয়ে যাওয়া গেলে মগজাস্ত্র চালিয়ে তিনি নির্ঘাৎ বলে দিতে পারতেন, দাদা অভিজিতের জন্য প্রচার করবেন বলে রাষ্ট্রপতি-তনয়া শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় মাত্র দু’দিনের ঝটিকা সফরে জঙ্গিপুরে এসেছিলেন কেন? বসিরহাট থেকে রফতানি হওয়া তৃণমূল প্রার্থী হাজি নুরুল ইসলামই বা কেন তাঁর নিজের জেতা কেন্দ্র ছেড়ে আসার প্রশ্নে শুধুই মুচকি হেসে বলছেন, “দিদি আমাকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে এখানে পাঠিয়েছেন।”

দেবাশিস ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০১৪ ০৩:২৬

শশীবাবুর ‘সিং’, আর আখতারি গজল!

জটিল ধাঁধার জট ছাড়িয়ে রহস্যের সমাধান করে দিয়েছিলেন ফেলু মিত্তির। তাঁকে এখন একটিবার জঙ্গিপুরে নিয়ে যাওয়া গেলে মগজাস্ত্র চালিয়ে তিনি নির্ঘাৎ বলে দিতে পারতেন, দাদা অভিজিতের জন্য প্রচার করবেন বলে রাষ্ট্রপতি-তনয়া শর্মিষ্ঠা মুখোপাধ্যায় মাত্র দু’দিনের ঝটিকা সফরে জঙ্গিপুরে এসেছিলেন কেন? বসিরহাট থেকে রফতানি হওয়া তৃণমূল প্রার্থী হাজি নুরুল ইসলামই বা কেন তাঁর নিজের জেতা কেন্দ্র ছেড়ে আসার প্রশ্নে শুধুই মুচকি হেসে বলছেন, “দিদি আমাকে একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে এখানে পাঠিয়েছেন।”

কী সেই উদ্দেশ্য? নুরুলের অফিসিয়াল জবাব, “দিদি বললেন, তোকে আমি জঙ্গিপুরে পাঠাচ্ছি। একটা বিশেষ উদ্দেশ্য আছে। চলে এলাম। বাকি উদ্দেশ্যটা দিদি জানেন।”ইতিহাস কিন্তু এটাও জানে, ২০০৪-এ প্রণব মুখোপাধ্যায় যে বার জীবনে প্রথম জনগণের ভোটে এখান থেকে জিতে সাংসদ হন, তখন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রণববাবুর বিরুদ্ধে মদন মিত্রকে প্রার্থী করবেন বলে স্থির করেছিলেন। তাঁর নাম এক প্রকার ঘোষণাও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে তাঁর বদলে আরএসপি-র দলছুট শীষ মহম্মদকে ঘাসফুল প্রতীকে দাঁড় করানো হয়। ২০০৯-এ কংগ্রেস-তৃণমূল জোট হয়েছিল। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হয়ে যাওয়ার পরে ২০১১-র উপনির্বাচনে অভিজিতের বিরুদ্ধে তৃণমূল প্রার্থীই দেয়নি। যৎসামান্য ভোটে তিনি মানরক্ষা করেন। এ বার ‘বিশেষ উদ্দেশ্যে’ হাজির হাজি। আর শর্মিষ্ঠা হঠাৎ দু-দিনের জন্য আসতে গেলেন কেন? সপ্রতিভ, সদালাপী, নজর-কাড়া সৌজন্য তাঁর। হেসে বললেন, “দাদার জন্য আসব না?” কিন্তু মাত্র দু’দিন? এ বারেও হাসি: “ওই যেটুকু পারলাম!”

বিকেলে অল্প সময় শহরের মধ্যেই এ-পাড়া, ও-পাড়া ঘুরে ঘুরে হাতজোড় করে দাদার জন্য ভোট-ভিক্ষা: “আমি আপনাদের সকলের চেনা প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে। এখানকার কংগ্রেস প্রার্থী অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় আমার দাদা। আপনারা আমার দাদাকে ভোট দিন”। আবেদনে সাড়া মিলল, অথবা মিলল না শর্মিষ্ঠা সবিনয়ে তাঁর কথা বলতে বলতে এগিয়ে চললেন।

শুধু এইটুকু প্রচারের জন্য দিল্লি থেকে জঙ্গিপুর! নাকি সঙ্গে আরও কিছু? ফেলুদা জানলেও জানতে পারেন!

রাষ্ট্রপতি রাজনীতির ঊর্ধ্বে। তবে শর্মিষ্ঠাকে এখানে আসার আগে প্রণব মুখোপাধ্যায় বলে দিয়েছিলেন, ভোটের প্রচারে বেরোলে শাড়ি মাস্ট। অন্য কোনও পোশাক নয়। ছেলের জন্য কোনও উপদেশ? তা-ও আছে। মাথা ঠান্ডা রেখে সকলের সঙ্গে মধুর ব্যবহার করতে হবে। ভোটের সময় মেজাজ হারাতে নেই।

সেই পিতৃ-উপদেশ সব সময় অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে পারছেন, তেমন দাবি হয়তো স্বয়ং অভিজিৎও করবেন না। নইলে ছোট-বড়-মাঝারি নেতাদের মাঝেমধ্যেই মুখঝামটা খেতে হয় কেন? দিন কয়েক আগেই যেমন হল। এক ব্লক কংগ্রেস সভাপতি দলবল নিয়ে সকালে প্রার্থীর বাড়িতে হাজির। আগাম খবর না দিয়ে এ ভাবে দেখা করতে আসা! বিরক্ত অভিজিৎ ভদ্রলোককে মুখের ওপর বলেই দিলেন, ব্লক-সভাপতি যেন ব্লকে গিয়ে কাজ করেন। এখানে তাঁকে কেউ আসতে বলেনি। সঙ্গে আসা লোকজনের সামনে ‘অসম্মানিত’ ওই ব্লক কংগ্রেস সভাপতির তখন প্রায় ‘ধরণী, দ্বিধা হও’ অবস্থা! সেই সকালের চাপ তাঁর বুক থেকে এখনও নামেনি। কথা বললেই বোঝা যায়, তিনি সেটা মনে রেখেছেন। “আমার দাদা ভীষণ স্পষ্টবক্তা। মুখে এবং মনে এক রকম। অপ্রিয় সত্য যে সব সময় বলতে নেই, এটা ও বুঝতেই চায় না। তাতেই অনেক সময় লোকে ওকে ভুল বোঝে। সবাই ভাবে, ও মেজাজ দেখাচ্ছে। কিন্তু এটাই ওর স্বভাব।” শর্মিষ্ঠার কথায় দোষ স্খালনের চেষ্টা স্পষ্ট।

আসলে আড়াই বছর আগের উপনির্বাচনে মাত্র আড়াই হাজার ভোটে জিতে সাংসদ হওয়া প্রণব-পুত্রের সামনে পথটা যে খুব মসৃণ নয়, সেটা বুঝতে জ্যোতিষচর্চার প্রয়োজন হয় না। ভাঙাচোরা গ্রাম্য রাস্তায় ঢেউয়ে দোলা নৌকোর মতো ওঠানামা করতে করতে একটি ছোট লরির উপর দাঁড়িয়ে অভিজিৎ মুখোপাধ্যায় তাই ঘুরেই চলেছেন।

এবং যত ঘুরছেন, ততই তাঁর মালুম হচ্ছে, পিতৃদত্ত ‘জমিদারি’তে বসতে পারলেই রাজনীতির ভিত কোনও জাদুমন্ত্রে মজবুত হয়ে যায় না। বরং হেভিওয়েট বাবার সঙ্গে তুলনাটা তাঁর ভাল-মন্দ, পারা-না-পারা, সাফল্য-ব্যর্থতা সব কিছু নিয়ে জগদ্দলের মতো ঘাড়ে চেপে বসে। সেটা যেমন প্লাস, তেমনই মাইনাস। রঘুনাথগঞ্জের সামান্য এক রেস্তোরাঁর ম্যানেজারও জানেন প্রণববাবুকে যে কথা মুখের উপর বলার সাহস কেউ রাখত না, তাঁর ছেলেকে এখন অনায়াসে তেমন অনেক প্রশ্নে জবাবদিহি চাওয়া যায়।

বদলেছে আরও অনেক। প্রণববাবুর মতো প্রচারের জৌলুস, বাড়িতে সদা ব্যস্ত, গমগমে পরিবেশ কিছুই আগের মতো নেই। শহরের উপকণ্ঠ দেউলে প্রণববাবুর নিজস্ব নতুন ঠিকানায় দাঁড়িয়ে বোঝার উপায় থাকে না যে, এটা ভোট-বাড়ি! এখান থেকেই লড়ছেন অভিজিৎ! সব কেমন যেন নিস্তরঙ্গ, শুনশান।

২০০৪-এ এখানে লড়তে এসে প্রণব মুখোপাধ্যায় থাকতেন বাগানবাড়ি এলাকায়। পরে ২০০৮-এ ম্যাকেঞ্জি রোডে বাড়ি ভাড়া নেন। গত লোকসভা ভোট সেখান থেকেই করেন তিনি। সেই থেকে রাষ্ট্রপতি হওয়া ইস্তক এটাই ছিল তাঁর জঙ্গিপুরের ঠিকানা। অবশেষে এখন নিজের বাড়ি।

ম্যাকেঞ্জি রোডের সেই বাড়িটার একতলার বারান্দায় গ্রিলের গায়ে এখনও ঝুলছে একটা ব্যানার। লেখাগুলি জ্বলজ্বলে “শুভ নববর্ষের আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। প্রণব মুখোপাধ্যায়। ১৪১৭।” পাশের ছবিটি অবশ্য চার বছরে অনেকটাই খুবলে গিয়েছে। কিন্তু তাতে প্রণববাবুকে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয় না। কালস্রোত যদি তাঁকে রাইসিনা হিলে না পৌঁছে না দিত, তাহলে আজ, ঠিক এই মুহূর্তে ওই ব্যানারটি হয়তো নতুন চেহারায় আরও বেশি অর্থবহ হয়ে উঠত!

শেষ পাতে একটি তথ্য, হাজি নুরুল জনান্তিকে বলে রেখেছেন, জঙ্গিপুরে জিতলে তিনিও একটি বাড়ি নেবেন। আর হারলে হোটেলে একটি স্থায়ী ঘর, যাতে মাসে দশ দিন এসে এলাকায় থাকতে পারেন!

debasish bhattacharya jangipur
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy