Advertisement
E-Paper

শিক্ষক কম, বিপাকে গ্রামের বহু স্কুল

শুধু নিয়োগেই নয়, শিক্ষকদের চাকরীস্থল নির্ধারণ থেকে শুরু করে বদলির ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক পরিচয় ও স্বজনপ্রীতি। ফলে শহরের সিংহভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষক বেশি রয়েছেন। অন্য দিকে প্রত্যন্ত গ্রাম ও সীমান্তের স্কুলগুলি পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। মানা হচ্ছে না শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত।

মনিরুল শেখ

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৫ ০১:১৫

শুধু নিয়োগেই নয়, শিক্ষকদের চাকরীস্থল নির্ধারণ থেকে শুরু করে বদলির ক্ষেত্রেও প্রাধান্য পেয়েছে রাজনৈতিক পরিচয় ও স্বজনপ্রীতি। ফলে শহরের সিংহভাগ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষক বেশি রয়েছেন। অন্য দিকে প্রত্যন্ত গ্রাম ও সীমান্তের স্কুলগুলি পর্যাপ্ত শিক্ষকের অভাবে ধুঁকছে। মানা হচ্ছে না শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাত।

নদিয়া জেলায় প্রায় ২৬০০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। গত বছরের প্রথম দিকে জেলায় ১৭৮৩ জন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। নিয়োগের আগে জেলার বিভিন্ন চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকরা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের কাছে বিভিন্ন স্কুলে শূন্যপদের তথ্য দিয়ে শিক্ষক চেয়ে আবেদন করেন। কিন্তু সেই আবেদন বাস্তবে মানা হয়নি। অভিযোগ, শহরের স্কুলগুলিতে প্রয়োজন না থাকলেও শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। অন্যদিকে শহর থেকে দূরে সীমান্তবর্তী প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলগুলিতে কম সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে। শিক্ষকের এই অসম বণ্টনের জন্য ভুগছে গ্রামীণ স্কুলগুলি।

শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী, পড়ুয়া সংখ্যা দেড়শোর মধ্যে হলে প্রতি ৩০ জন ছাত্র পিছু একজন করে শিক্ষক থাকবে। ছাত্র সংখ্যা তার বেশি হলে প্রতি চল্লিশ জন পড়ুয়া পিছু একজন করে শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু অপরিকল্পিত ভাবে শিক্ষকদের কর্মস্থল নির্ধারণ করার ফলে গ্রামের স্কুলগুলিতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত মানা হচ্ছে না।

কৃষ্ণনগর সদর চক্রের অধীনে রয়েছে ৬২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানকার অধিকাংশ স্কুলেই ছাত্র অনুপাতে শিক্ষক বেশি রয়েছেন। যেমন গঙ্গাবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছাত্র সংখ্যা মাত্র ২ জন। সেখানে শিক্ষকও রয়েছেন ২ জন। চাষাপাড়া প্রাথমিক স্কুলে পড়ুয়া রয়েছে সাকুল্যে ১৬ জন। সেখানে শিক্ষক রয়েছেন ২ জন। একই অবস্থা চাঁদসড়ক আদর্শ সমাজ বিদ্যালয়েও। সেখানে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ১৬। শিক্ষক রয়েছেন ২ জন। এছাড়াও রামকৃষ্ণ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া রয়েছে মাত্র ৩২ জন। কিন্তু শিক্ষক রয়েছেন ৩ জন।

শহরের হিন্দু কল্যাণ প্রাথমিক বালিকা বিদ্যালয়ে ছাত্রী সংখ্যা ৬০। শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা ৫। কালীনগর নিমতলা প্রাথমিক বিদ্যালয়েও অনুপাতের থেকে বেশি শিক্ষক রয়েছেন। সেখানে পড়ুয়া আছে ৫৩ জন। কিন্তু শিক্ষকের সংখ্যা ৪। এছাড়াও জেলার ছোট শহর নবদ্বীপ, চাকদহ, রানাঘাট, কল্যাণীর স্কুলগুলিতেও একই চিত্র। সেখানকার প্রাথমিক স্কুলগুলিতেও অনেকক্ষেত্রে অনুপাতের থেকে বেশি শিক্ষক রয়েছেন।

কিন্তু গ্রামের স্কুলগুলির অবস্থা সঙ্গীন। সেখানকার বেশিরভাগ স্কুলে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম। জেলার শেষ প্রান্ত, করিমপুরে রয়েছে তিনটি চক্র। করিমপুর নতুন চক্রের অধীনে ৫০টি স্কুল রয়েছে। সীমান্তের এই স্কুলগুলিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ছাত্রের তুলনায় শিক্ষকের পরিমাণ কম। যেমন মালিথ্যাপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৩৬১ জন পড়ুয়া রয়েছে। ওই স্কুলে অন্তত ৯ জন শিক্ষক থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে রয়েছেন ৩ জন। সাহেবপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২৮১ জন ছাত্র থাকলেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ২ জন।

লক্ষ্মীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া রয়েছে ১৮৮ জন। কিন্তু এখানে শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ২ জন। বস্তুত গোটা তেহট্ট মহাকুমারই বিভিন্ন স্কুলে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম। তেহট্ট বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকার স্কুলগুলিতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ঠিক থাকলেও বড় রাস্তা থেকে দূরে গ্রামের স্কুলগুলিতে সে সবের কোনও তোয়াক্কা করা হয়নি। যেমন তেহট্ট নতুন চক্রের অধীনে বারুইপাড়া বিএস প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ১৮৫ জন ছাত্র থাকলেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ২ জন। বড়েয়া পশ্চিমপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ২১৩ জন পড়ুয়া থাকলেও শিক্ষক রয়েছেন মাত্র ৩ জন। করিমপুর চক্রের দেওয়ানগঞ্জ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ুয়া সংখ্যা ১৬৭। কিন্তু শিক্ষক রয়েছেন ৩ জন।

একই অবস্থা নাকাশিপাড়া চক্রেরও। এখানে জাতীয় সড়কের আশপাশের স্কুলগুলিতে প্রয়োজন মাফিক শিক্ষক থাকলেও গ্রামের স্কুলগুলিতে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষক কম রয়েছেন। গঙ্গার ধারের চর কুর্মীপাড়া বা পাটপুকুর, শালীগ্রাম প্রভৃতি জায়গার বহু স্কুলে ছাত্রের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা অনেক কম।

এই অবস্থার জন্য জেলার একাধিক চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শক ও সহকারী বিদ্যালয় পরিদর্শকরা তৃণমূল প্রভাবিত বর্তমান জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের বদলি ও নতুন শিক্ষকদের স্কুল বাছাইয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক রং বিচারের নীতিকে দায়ী করছেন।

পরিবর্তনের পর বাম প্রভাবিত নিখিলবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির সদস্যদের যথেচ্ছ ভাবে বদলি করা হয় বলে অভিযোগ। কিন্তু বদলির পর পুরনো স্কুলে নতুন শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি বলেও বিরোধীরা অভিযোগ করছেন। সংগঠনের নদিয়া জেলার সম্পাদক চূড়ামনি দাস বর্মন বলেন, “আমাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের অনেককেই রাতারাতি বদলি করে দিয়েছে নতুন সরকার। ফলে পুরনো জায়গায় শিক্ষকের ঘাটতি থেকেই গিয়েছে।”

এ ছাড়াও ক্ষমতাবদলের পরে অনেক শিক্ষকই শাসক দলে নাম লেখান। ওই শিক্ষকরাও জেলার প্রাথমিক শিক্ষা সংসদে নিজেদের নতুন রাজনৈতিক পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে বাড়ির পাশে বা শহরের কোনও স্কুলে চলে এসেছেন। ফলে সীমান্তের কিছু এলাকা ও প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলগুলি কার্যত শিক্ষক-শূন্য হয়ে পড়ে। ২০১২-২০১৩ সালে জেলা জুড়ে ব্যাপক ভাবে প্রাথমিক শিক্ষকদের বদলি করা হয়। তারপর পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছে যে গত বছরের জুলাই মাস থেকে রাজ্যের শিক্ষা দফতরের নির্দেশে বন্ধ হয়েছে বদলি নীতি। কিন্তু ফল যা হওয়ার তা তো অনেক আগেও ঘটে গিয়েছে।

নতুন শিক্ষকদের গ্রাম বা সীমান্তের স্কুলগুলিতে পাঠানো হল না কেন? জেলার একাধিক চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকেরা ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন, ‘‘প্রয়োজন হলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ শিক্ষককে যে কোনও স্কুলে পাঠাতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি। গ্রামের দিকে আমরা যে সংখ্যক নতুন শিক্ষক চেয়েছিলাম, তার সিকিভাগও অনেকক্ষেত্রে পাইনি।’’

যেমন করিমপুর নতুন চক্রের ৫০টি স্কুলে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে বহু দিন থেকে। পরে নতুন শিক্ষক নিয়োগের পর ওই চক্র সাকুল্যে ২৩ জন শিক্ষক পেয়েছে। এমনটা কেন হল? নদিয়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের চেয়ারম্যান অর্চনা ঘোষ সরকারের সাফাই, “গ্রামের বা সীমান্ত লাগোয়া এলাকার খুব কম পরীক্ষার্থী চাকরি পেয়েছেন। তাই ওই এলাকায় বেশি শিক্ষক দেওয়া যায়নি। অন্য দিকে, শহরের যাঁরা চাকরি পেয়েছেন তাঁরা সকলেই নিজেদের এলাকার স্কুলগুলিকেই বেছে নিয়েছেন।”

কিন্তু এর ফলে তো ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত মানা হল না। তাছাড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ সব জেনেও কেন গ্রামের স্কুলগুলিতে শিক্ষক দিলেন না? সে প্রশ্নের অবশ্য সদুত্তর মেলেনি।

অন্য দিকে পড়শি জেলা, মুর্শিদাবাদের অবস্থাও তথৈবচ। জেলায় ৪১টি চক্রে প্রাথমিক স্কুলের সংখ্যা ৩১৭৩টি। জেলায় একজন কিংবা দু’জন বা ২জন শিক্ষক বিশিষ্ট এরকম স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৭০০ টিরও বেশি। পাশাপাশি ছাত্র অনুপাতে বাড়তি শিক্ষক রয়েছে, এমন স্কুলের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। মুর্শিদাবাদ জেলা প্রাথমিক শিক্ষা সংসদের সভাপতি দেবাশিস বৈশ্য বলেন, “নতুন নিয়োগ হচ্ছে না। একের পর এক শিক্ষকেরা অবসর নিচ্ছেন। এই সমস্যা বেড়েই চলেছে। সঙ্কট কাটাতে প্রতিটি চক্রের অবর বিদ্যালয় পরিদর্শকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ছাত্র অনুপাতে বেশি শিক্ষক রয়েছে যে সব স্কুলে দ্রুত তার তালিকা পাঠাতে। বাড়তি শিক্ষকদের সেই সব স্কুলে বদলি করে দেওয়া হবে।”

(সহ প্রতিবেদন: বিমান হাজরা)

teacher school manirul islam biman hazra
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy