Advertisement
E-Paper

লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা নেই, রাজ্য জুড়ে হাহাকার

মাসের চতুর্থ শনিবার বলে একে আজ ব্যাঙ্ক বন্ধ, তার ওপর বৃহস্পতিবার রাত থেকেই গুজব ছড়ায়— সোমবার ভারত বন্‌ধ। ফলে রাজ্য জুড়ে ব্যাঙ্কগুলিতে ভিড়ের বহর কর্তৃপক্ষের সমস্ত অনুমানকে ছাপিয়ে গেল।

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:৪২
মুর্শিদাবাদে ইউবিআই লালগোলা শাখায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

মুর্শিদাবাদে ইউবিআই লালগোলা শাখায় তোলা নিজস্ব চিত্র।

মাসের চতুর্থ শনিবার বলে একে আজ ব্যাঙ্ক বন্ধ, তার ওপর বৃহস্পতিবার রাত থেকেই গুজব ছড়ায়— সোমবার ভারত বন্‌ধ। ফলে রাজ্য জুড়ে ব্যাঙ্কগুলিতে ভিড়ের বহর কর্তৃপক্ষের সমস্ত অনুমানকে ছাপিয়ে গেল। এবং সরকারের বেঁধে দেওয়া সর্বাধিক সীমা অনুযায়ী কাজ করেও সব মানুষকে তাঁদের চাহিদার টাকা এ দিন দিতে পারল না অধিকাংশ ব্যাঙ্ক।

সব ব্যাঙ্কেরই বক্তব্য এক— চাহিদা অনুযায়ী নোটের জোগান নেই।

এটিএমে দিনের বেশির ভাগ সময় নগদ না-থাকার বিষয়টি মানুষ তা-ও মেনে নিয়েছেন। তবে ব্যাঙ্কে দীর্ঘ ক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়েও টাকা না-পেয়ে কিংবা অনেক কম টাকা পেয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন মানুষ। মুর্শিদাবাদে টাকা তুলতে না-পেরে রাস্তা অবরোধের ঘটনাও ঘটেছে।

এ দিন বিকেল সাড়ে তিনটেয় ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার যোধপুর পার্ক শাখা থেকে বলে দেওয়া হয়, বাইরে যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন, তাঁদের কাউকে টাকা দেওয়া সম্ভব নয়। বাইরে তখন জনা পঁয়ত্রিশের লাইন। ব্যাঙ্ক বন্ধ হয় বিকেল চারটেয়। ওই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে ভেসে এল অশ্রাব্য গালিগালাজ। নিরাপত্তা রক্ষী শিবনাথ দে-র সঙ্গে কয়েক জনের হাতাহাতি বেঁধে যাওয়ার উপক্রম। ক্যাশিয়ার রাজু দাস জানালেন, দুই টেলার অর্ণব দাস ও মিনারানি কর বৃহস্পতিবার সারা দিনে যেখানে গ্রাহকদের ২৫ লক্ষ টাকা দিয়েছেন, এ দিন সেখানে

৪৫ লক্ষ টাকা শেষ হয়ে যায় বিকেল সাড়ে তিনটেয়।

ইন্ডিয়ান ব্যাঙ্কের বালিগঞ্জ শাখার ম্যানেজার শশী ঝা জানান, এ দিন কারেন্সি চেস্ট থেকে তাঁরা নগদ ৯ লক্ষ টাকা পান। কিন্তু দুপুর ২টোতেই বোঝা যায়, টাকা ফুরিয়ে যাচ্ছে। কারেন্ট অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে আসা অনেককেই খালি হাতে ফেরাতে হবে। তখন ফের নগদ আনতে পাঠানো হয়।

জেলাগুলির অবস্থা আরও শোচনীয়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ব্যাঙ্কগুলির কাজ দেখভাল করার দায়িত্বে বা লিড ব্যাঙ্ক হিসেবে কাজ করে ইউবিআই। তার ম্যানেজার অসীম পণ্ডিত বলেন, ‘‘জেলার বিভিন্ন ব্যাঙ্কের জন্য যে টাকা এসেছে, তা চাহিদার তুলনায় অর্ধেকও নয়।’’ টাকার জোগান না থাকায় কাঁথির অধিকাংশ ব্যাঙ্ক তিন হাজার টাকা করে গ্রাহকদের দিয়েছে। সব চেয়ে করুণ অবস্থা বঙ্গীয় গ্রামীণ বিকাশ ব্যাঙ্কগুলির। তারা সর্বোচ্চ দু’হাজার টাকা দিতে পেরেছে। ব্যাঙ্কের দইসাই শাখার এক আধিকারিক জানালেন, কোনও গ্রাহক অসুস্থ হলে বা তেমন জরুরি প্রয়োজনের প্রমাণ হিসেবে নথি দেখালে মিলছে দশ হাজার টাকা।

পশ্চিম মেদিনীপুরের বহু ব্যাঙ্কেও নোটের তীব্র আকাল। লিড ডিস্ট্রিক্ট ব্যাঙ্ক, ইউবিআইয়ের এক কর্তা বলেন, “এখনও রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থেকে টাকা আসেনি। কলকাতার হেড অফিস থেকে টাকা নিয়ে এসে পরিস্থিতি সামাল দিতে হচ্ছে।”

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তরফে কিন্তু বলা হয়েছিল, শহরের প্রয়োজন প্রাথমিক ভাবে মিটিয়ে শুক্রবার নোটের জোগান দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পাবে জেলার ব্যাঙ্কগুলি। অথচ জেলায় জেলায় পরিস্থিতির কোনও উন্নতি মালুম হচ্ছে না। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অবশ্য বরাবরই দাবি করছে— নোটের জোগানে ঘাটতি তাদের তরফে নেই।

অথচ বর্ধমানের বহু ব্যাঙ্ক এ দিন গ্রাহকদের পাঁচ হাজার টাকার বেশি দিতে পারেনি। উত্তর ২৪ পরগনার অধিকাংশ ব্যাঙ্কের কোথাও সর্বাধিক পাঁচ, কোথাও সাত হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজারের কথায়, ‘‘ টাকার জোগান ঠিকঠাক না পেলে কোথা থেকে দেব!’’

বাঁকুড়ার অধিকাংশ ব্যাঙ্ক এ দিন গ্রাহকদের সর্বোচ্চ সাড়ে তিন বা চার হাজার টাকার বেশি দিতে পারেনি। বীরভূমের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের কোনওটি দু’হাজার, কোনওটি আড়াই হাজার টাকা দিয়েছে। দুবরাজপুরের ব্যবসায়ী উদয় দত্ত ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলে বেরোনোর সময়ে বললেন, ‘‘আড়াই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে পেলাম মাত্র আড়াই হাজার। এ ভাবে চলে?’’

জলপাইগুড়ি জেলায় সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের বিভিন্ন শাখা মিলিয়ে রোজ আট-দশ কোটি টাকার প্রয়োজন বলে জানাচ্ছেন কর্তৃপক্ষ। অথচ তাঁদের হাতে দু’কোটি টাকার বেশি নেই। কোচবিহার জেলায় রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি মিলিয়ে ২৩টি ব্যাঙ্ক ব্যবসা করে, যাদের মোট শাখার সংখ্যা ২০৪। লেনদেনের জন্য রোজ গড়ে মোট দেড়শো কোটি টাকার প্রয়োজন। অথচ বড়জোর ৩০ কোটি রয়েছে ব্যাঙ্কগুলির হাতে।

নোটের জোগান কম থাকার কারণেই নদিয়ার শিমুরালির একটি ব্যাঙ্ক দিনে দু’হাজার টাকার বেশি গ্রাহকদের দিতে পারছে না। চাকদহের চান্দুরিয়ার বাসিন্দা অমল হালদার বলেন, ‘‘শুক্রবার ব্যাঙ্কে ২০ হাজার টাকা তুলতে গিয়েছিলাম। পেলাম ২০০০ টাকা।’’

মুর্শিদাবাদে ইউবিআইয়ের লালগোলা শাখা এ দিন সকালেই নোটিস ঝুলিয়ে দেয়— ‘টাকা না থাকায় আজ দেওয়া যাচ্ছে না।’’ ওই জেলার লিড ব্যাঙ্কও ইউবিআই। তার ম্যানেজার অমিত সিংহ বলেন, ‘‘টাকার জোগান না থাকায় এই হাল।’’ এই জেলার মেহদিপুরে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে না-পেরে প্রায় আধ ঘণ্টা জাতীয় সড়ক অবরোধ করেন বাসিন্দারা।

এ দিন মালদহের চাঁচল ডাকঘর কাউকেই কোনও টাকা দিতে পারেনি। জেলাগুলি তাদের অগ্রাধিকার বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক দাবি করলেও মুখ থুবড়ে পড়েছে ডাকঘরের পরিষেবা। জেলায়, প্রত্যন্ত গ্রামে যেগুলি গরিব মানুষের আর্থিক লেনদেনের প্রাণভোমরা। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক থেকে শিলিগুড়ির প্রধান ডাকঘর টাকা পায়। এই সপ্তাহে গত দু’দিন এক টাকাও পায়নি। মালদহের চাঁচল ডাকঘরে রোজ গড়ে পাঁচ-ছ’লক্ষ টাকা দরকার। কিন্তু গত কয়েক দিন যাবৎ ৫০ হাজার থেকে এক লক্ষ টাকার বেশি মিলছে না।

উত্তর দিনাজপুরের ইসলামপুর ডাকঘরের পোস্টমাস্টার নিরঞ্জন রায়ের কথায়, ‘‘এখানে এসবিআই থেকে টাকা আসে। কিন্তু যা মিলছে, সেটা নেহাৎই কম।’’ যে কারণে বহরমপুরের গোরাবাজার ডাকঘর থেকে এ দিন এক-এক জনকে দু’-আড়াই হাজার টাকার বেশি দেওয়া হয়নি। জোগান কম থাকার কারণেই এ দিন ডায়মন্ড হারবার মুখ্য ডাকঘর থেকে কোনও টাকা কাকদ্বীপ ডাকঘরে পৌঁছয়নি। ফলে, যেটুকু জমা ছিল তা থেকে গ্রাহক পিছু দু’হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। ওই ডাকঘরে নোটিস দিয়ে বলা হয়েছে—শনিবারও গ্রাহকদের টাকা দেওয়া যাবে না।

New Currency Long Queues
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy