টিভি, ফ্রিজ়, ল্যাপটপ, মোবাইল-সহ যে কোনও বৈদ্যুতিন পণ্য কেনার সময় এখন ‘রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি’ মেলে। দেশি কাট্টা কিনলেও মিলছে একই সুবিধা! শুধু তাই নয়, মোবাইলের বিভিন্ন মডেলের মতো এক একটা দেশি কাট্টার এক এক করে নাম রাখা হয়েছে। কারও নাম ‘মিনি থাগ’ তো কেউ ‘সাইলেন্ট স্টিং’ বা ‘রকিং কার্ভ।’ লক্ষ্য, প্রতিযোগিতার বাজারে অস্ত্রের বিপণন বাড়ানো। খরিদ্দার টানতে বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায়ীরা আগাগোড়া বদলে ফেলেছেন বিপণন কৌশল। নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদ থেকে বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারির পর এমনই সব তথ্য পেল পুলিশ।
রাজ্যের গোয়েন্দা বিভাগের এক কর্তার কথায়, “আগে দেশি অস্ত্র মানেই ছিল জোড়াতালি দেওয়া লোহার তৈরি কিছু পাইপগান আর ওয়ান শটার। এখন সে সব গিয়েছে। অস্ত্র সরবরাহকারীরা এখন ‘ব্র্যান্ড স্ট্র্যাটেজি’ নিয়ে কাজকর্ম করছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রের সঙ্গে মিলছে ভিজ়িটিং কার্ড পর্যন্ত।” বলতে বলতে বিস্ময়ের সুর ওই গোয়েন্দাকর্তার গলায়। তিনি জানাচ্ছেন, এ সবের মধ্যে সবচেয়ে ‘চমকপ্রদ’ যেটা, সেটা হল ‘রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি।’ অর্থাৎ, কেনা আগ্নেয়াস্ত্র যদি প্রতিশ্রুতি মতো কাজ না করে, তা হলে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ফেরত দিয়ে নতুন আর একটি পাওয়া যাবে। বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র-সমেত নদিয়ায় পুলিশের হাতে পাকড়াও এক দুষ্কৃতী পুলিশি জেরায় জানিয়েছে, দশটার মধ্যে তিনটে দেশি কাট্টা কাজ করছিল না তার। ‘দোকানদার’কে ফোন করতেই বলল, ‘দাদা, চিন্তা করবেন না, কাল (আগামিকাল) বিকেলেই নতুন একটা দিচ্ছি।’’ সেই ‘রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি’র জিনিস নিতে গিয়ে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে সে।
পুলিশ সূত্রে খবর, এ ধরনের ‘অফার’ শুধু অস্ত্র বিক্রিতে নয়, নতুন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের উৎসাহ দিতেও বড় ভূমিকা নিচ্ছে। কমবয়সি দুষ্কৃতী বা অপরাধ জগতে সদ্য হাত পাকানো কাউকে আকর্ষিত করতে দেশি কাট্টার বিপণন কৌশলে বদল এনেছে কারবারিরা। এমনকি, কিছু নিষিদ্ধ মেসেজিং অ্যাপে তৈরি হয়েছে ‘ওয়ারেন্টি গ্রুপ’, যেখানে সদস্যরা তাদের অস্ত্র কেনার অভিজ্ঞতা ‘শেয়ার’ করছে। কোনও ই-কমার্স সংস্থা থেকে জিনিসপত্র কিনলে যেমন ‘রিভিউ’ দেন ক্রেতারা, তেমন ওই গ্রুপে অস্ত্র কেনার অভিজ্ঞতার কথা বলা হচ্ছে।
সীমান্তবর্তী দুই জেলা, নদিয়া ও মুর্শিদাবাদে চলতি বছরে প্রথম চার মাসে বেশ কয়েক জন অস্ত্র কারবারি গ্রেফতার হয়েছে। মুর্শিদাবাদের এমনই এক কারবারির কাছ থেকে মেলা তথ্যের ভিত্তিতে হানা দিয়ে বেশ কিছু দেশি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করে পুলিশ। দিন কয়েক আগে নদিয়ার বগুলা বাজারে ১৭ রাউন্ড কার্তুজ-সহ এক যুবককে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে মুর্শিদাবাদের দু’টি বেআইনি অস্ত্র কারখানার সন্ধান মেলে। নবদ্বীপ মহীশূর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার মাঝেরচরে হানা দিয়ে এক জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাকে জেরা করে অস্ত্র ব্যবসায়ী নতুন ট্রেন্ডের কথা প্রথম জানতে পারে পুলিশ।
আরও পড়ুন:
চলতি মাসে মুর্শিদাবাদের নওগাঁয় সাতটি আগ্নেয়াস্ত্র-সহ ১৩টি ম্যাগাজ়িন এবং ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার হয়। হাবুল শেখ নামে এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পারে, ‘রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি’র কথা। অন্য দিকে, মুর্শিদাবাদের ডোমকলে ঠিকমতো কাজ না করা তিনটি দেশি কাট্টা বদলাতে এসে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এক দুষ্কৃতী। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, দশটি মধ্যে তিনটি কাট্টা ‘কাস্টমার’দের কাছ থেকে ‘রিটার্ন’ এসেছে। সেই অস্ত্রগুলি ‘রিপ্লেসমেন্ট ওয়ারেন্টি’তে নিতে এসেছিল সে। প্রতিটি ঘটনাই উদ্বেগ বাড়িয়েছে পুলিশের অন্দরে। মুর্শিদাবাদ পুলিশ জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাজিদ ইকবালের কথায়, ‘‘বেআইনি অস্ত্র ব্যবসায় নিত্যনতুন কৌশল বদলে ব্যবসার চেষ্টা চলছে। অনেক যুবক এই অবৈধ এবং অপরাধমূলক কারবারে জড়িয়ে পড়ছেন। সেটা উদ্বেগজনক। তবে পুলিশের লাগাতার অভিযানে এদের অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। বেশ কয়েক’টি অস্ত্র কারখানায় হানা দেওয়া হয়েছে। আশা করছি, দ্রুত এই প্রবণতার রাশ টানা যাবে।’’