Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
TMC

Panihati Murder Case: ‘কাজ’ না করায় হামলা হয় ‘সুপারি কিলার’-এর উপরেও! কাউন্সিলর খুনে উঠে এল নয়া তথ্য

পানিহাটির তৃণমূল কাউন্সিলর খুনের সূত্রে এ দিন কালনা থেকে সঞ্জীব পণ্ডিত ওরফে বাপিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে পানিহাটি পুরসভার পূর্ত বিভাগের ঠিকাদার ছিল। আজ, বুধবার তাকে আদালতে হাজির করা হবে।

অনুপম-হত্যার প্রতিবাদ মিছিলে নিহতের স্ত্রী মীনাক্ষী দত্ত (ডান দিকে)। মঙ্গলবার পানিহাটিতে।

অনুপম-হত্যার প্রতিবাদ মিছিলে নিহতের স্ত্রী মীনাক্ষী দত্ত (ডান দিকে)। মঙ্গলবার পানিহাটিতে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ মার্চ ২০২২ ০৪:৩০
Share: Save:

পানিহাটি তদন্তের জল যত গড়াচ্ছে, তত বেশি করে উঠে আসছে চমকপ্রদ তথ্য। ৮ নম্বর ওয়ার্ডের নব নির্বাচিত তৃণমূল কাউন্সিলর অনুপম দত্তকে মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করা খুনি যে আদতে ‘সুপারি কিলার’, তা জানা গিয়েছিল সোমবারই। এর পরে মঙ্গলবার জানা গেল, অনুপমকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল বেশ কয়েক মাস আগেই। নিযুক্ত হয়েছিল আর এক সুপারি কিলার। কিন্তু সে টাকা নিয়েও ‘কাজ না সেরে’ চম্পট দেওয়ার কারণে তার উপরেই হামলা হয়েছিল! নতুন করে ‘বরাত’ দেওয়া হয়েছিল অমিত পণ্ডিতকে। রবিবার অনুপমের মাথায় গুলি চালিয়ে খুনের অভিযোগে যাকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

ঘটনাটিকে ঘিরে এলাকায় যেমন ক্ষোভ এবং চাঞ্চল্য রয়েছে, তেমনই এতে ক্রমশ রং গাঢ় হচ্ছে রাজনীতির। এই ঘটনার সূত্রে এ দিন যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তার বিজেপি-যোগের দিকে আঙুল উঠেছে। আবার বিজেপির দাবি, এই হত্যা তৃণমূলের অন্তর্দ্বন্দ্বের ফসল। বিরোধী নেতা শুভেন্দু অধিকারী সিবিআই তদন্তের কথা বলেছেন। কিন্তু নিহতের স্ত্রী মীনাক্ষী দত্ত এ দিন আস্থা রেখেছেন মুখ্যমন্ত্রী এবং পুলিশি তদন্তের উপরে।

পানিহাটির তৃণমূল কাউন্সিলর খুনের সূত্রে এ দিন কালনা থেকে সঞ্জীব পণ্ডিত ওরফে বাপিকে গ্রেফতার করে পুলিশ। সে পানিহাটি পুরসভার পূর্ত বিভাগের ঠিকাদার ছিল। আজ, বুধবার তাকে আদালতে হাজির করা হবে। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার মনোজ বর্মা বলেন, ‘‘রবিবার ঘটনার পরেই অমিত গ্রেফতার হয়েছে। তার পরে সঞ্জীবকেও ধরা হয়েছে। জেরায় জানা যাচ্ছে, খুনের ঘটনার সঙ্গে ওর সরাসরি যোগ রয়েছে। নেপথ্যের কারণ আরও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

সূত্রের খবর, অমিত সঞ্জীবের পিসতুতো ভাই। বাইরের সুপারি কিলারকে দিয়ে ‘কাজ না হওয়ায়’ নিজের আত্মীয় তথা ‘সুপারি কিলার’ অমিতকে কাজে লাগায় সঞ্জীব। রফা হয়েছিল তিন লক্ষ টাকায়। অগ্রিম এক লক্ষ টাকা দেওয়াও হয়েছিল।

কিন্তু আগের বার ‘কাজ’ হয়নি কেন? সূত্রের খবর, অনুপমকে সরিয়ে দিতে কয়েক মাস আগে হরিণঘাটার মোল্লাবেলিয়ার এক সুপারি কিলারকে চার লক্ষ টাকা দিয়েছিল সঞ্জীব। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও কাজ হচ্ছিল না। আবার টাকাও ফেরত দিচ্ছিল না সে। তখন সঞ্জীবের নির্দেশে অমিতই গুলি চালায় সেই সুপারি কিলারের উপরে! তবে প্রাণে বেঁচে যায় সে।

এর পরে এলাকা থেকে উধাও হয়ে যায় অমিত। তার খোঁজ শুরু করে হরিণঘাটা পুলিশ। কিন্তু বর্ধমান, কালনা, মেমারি, বিহারে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল ওই সুপারি কিলার। রবিবার রাতের ঘটনার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ প্রকাশ্যে আসতেই অমিতকে চিনতে পারেন হরিণঘাটার লোকজন। বিষয়টি জানতে পারেন ব্যারাকপুরের তদন্তকারীরাও।

রবিবার রাতেই খুনের ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ১০০ মিটার দূরে হোগলার জঙ্গল থেকে গ্রেফতার হয় অমিত। তাকে দফায় দফায় জেরা শুরু করেন তদন্তকারীরা। সূত্রের খবর, মোবাইলের কল-লিষ্ট, টাওয়ার লোকেশন পরীক্ষা করা হয়। তাতেই উঠে আসে সঞ্জীবের নাম। জানা যায়, ঘটনার দিন গুলি চালানোর কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত দু’জনের মধ্যে কথা হয়েছিল। তার পরে অবশ্য দু’জনেই মোবাইল বন্ধ করে দেয়। তদন্তকারীদের অনুমান, পানিহাটির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা সঞ্জীবের কাছ থেকেই গুলি চালানোর পরে পালানোর গলিপথ এবং হোগলার জঙ্গলের খোঁজ পেয়েছিল অমিত। সেই মতো সেখানে ঘাপটি মেরেছিল। আর দূরে অপেক্ষা করা সঞ্জীব বেগতিক বুঝে ভিড়ের মধ্যে থেকে বেরিয়ে কালনায় পালিয়ে যায়।

কিন্তু প্রশ্ন হল, অনুপম কখন বাড়ি থেকে বেরোবেন, কোন দিকে যাবেন, কোথায় রয়েছেন, তা কী করে জানল অমিতরা? এক পুলিশ কর্তার কথায়, ‘‘মূল অভিযুক্তকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে আরও জিজ্ঞাসাবাদ করে পুরো বিষয়টি জানা হবে।’’

তবে এ ভাবে খুনের ছক কষার কারণ অবশ্য এখনও পুরো স্পষ্ট নয়। স্থানীয় সূত্রের খবর, এক ঠিকাদারের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করলেও, বকলমে মালিক ছিল সঞ্জীবই। দীর্ঘদিন ধরেই স্থানীয় কাউন্সিলর অনুপমের সঙ্গে তার বিবাদ ছিল। স্থানীয় একটি ক্লাব সংলগ্ন জমির বিষয়েও ওই ঠিকাদারের বিরোধিতা করেছিলেন অনুপম। সঞ্জীব তখন শাসকদলের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও কাউন্সিলর তার কাজে সহমত হতেন না, বিরোধিতা করতেন। এরই প্রতিবাদে ২০১৯ সালে এক দিন রাতে প্রায় দু’শো লোক নিয়ে বিধায়ক নির্মল ঘোষের বাড়িতে সঞ্জীব হানা দেয় বলেও অভিযোগ। যদিও দলীয় নেতৃত্ব অনুপমের পাশে থাকায় আরও ক্ষোভ বাড়ে ওই যুবকের। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, টাকার জোরে সঞ্জীব এলাকার ক্ষমতা হাতে রাখার চেষ্টা করত। কিন্তু সেই পথে অন্যতম বাধা ছিলেন অনুপম। নিজের জায়গা করতে না পেরে শেষে বিজেপিতে যোগ দেয় সঞ্জীব। সংঘাত আরও বাড়ে। এক বার অনুপমের লোকজনের উপরেও হামলা করা হয় বলে অভিযোগ। পানিহাটির প্রাক্তন ভাইস চেয়ারম্যান মলয় রায় বলেন, ‘‘২০২১-এর ভোটে বিজেপির হয়েই কাজ করেছিল সঞ্জীব।’’

এ দিন মীনাক্ষীর অভিযোগ, ‘‘সঞ্জীব বিজেপি করত। ও চক্রান্ত করেই পুরো ঘটনা ঘটিয়েছে। তবে ঘটনার পিছনে সঞ্জীবের উপরের লোকজন তথা বিজেপির আরও বড় মাথা রয়েছে।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘পুলিশ ও সিআইডি-র উপরে ভরসা রাখছি। রাজ্য সরকারের উপরেও আস্থা রয়েছে। আমি, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাথে দেখা করে কথা বলতে চাই। উনি আমার মা। আমি ওঁকেই সব কিছু জানাব।’’ তৃণমূলের ব্যারাকপুর-দমদম সাংগঠনিক জেলার সভাপতি তথা বিধায়ক পার্থ ভৌমিক বলেন, ‘‘অনুপমের ঘটনায় জড়িতদের সকলকে ধরা হবে। মুখ্যমন্ত্রী বিষয়টির উপরে নজর রাখছেন।’’

এ দিন সন্ধ্যায় এলাকায় মোমবাতি মিছিল হয়। তাতে মীনাক্ষীও ছিলেন। স্থানীয়দের একাংশের মতে, দ্বিতীয় বার কাউন্সিলর হওয়ার পরে অনুপম আরও তীব্র বিরোধিতা করতে পারে বলে আশঙ্কা করেই সঞ্জীব কাজে লাগায় অমিতকে। মেমারি থেকে পানিহাটি আসার জন্য তাকে সব রকম সহযোগিতা করে। এ দিন বারুইপুর থেকে আরও দু’জনকে ঘটনায় জড়িত সন্দেহে আটক করে ব্যারাকপুর পুলিশ। যদিও তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আনা হয়েছিল বলেই দাবি তদন্তকারীদের।

সূত্রের খবর, অমিত ও সঞ্জীব বেআইনি অস্ত্র চোরাচালানেও যুক্ত ছিল। পুলিশ কমিশনার বলেন, ‘‘জিয়ারুল মণ্ডলের উপরে অমিত এর আগে যে আক্রমণ চালিয়েছিল, সেই অভিযোগ-সহ সব বিষয়ই খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’

বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, “ওঁর পরিবারকে আমার পরামর্শ, শোক কাটিয়ে উঠে আদালতের তত্ত্বাবধানে সিবিআই তদন্তের দাবি করুন। রাজ্য সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেবে না। তা পেতে আদালতে যেতে হবে।” যদিও অনুপমের পরিবার এ দিন সিআইডি-র উপরেই পূর্ণ আস্থা রেখেছে।

রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র শমীক ভট্টাচার্য বলেন, “সঞ্জীব তৃণমূলেই ছিলেন। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের আগে আরও অনেকের মতো তিনিও বিজেপিতে আসেন। ২মে ফল বেরোনোর পর থেকে দলের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ তাঁর নেই।... পুর বোর্ড, এলাকা এবং জমি দখলের জন্য তৃণমূলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের পরিণতি এই খুন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

TMC Murder Panihati
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE