E-Paper

লেনদেনে বেকারদের অ্যাকাউন্ট

হরেক উপায়ে বাজারে আসছে জাল ওষুধ। মধ্যস্থতাকারীরাও তাই সন্দেহের বাইরে নয়। নজরদারি কতটা, অভিযোগ উঠছে তা নিয়েও।

— প্রতীকী চিত্র।

শান্তনু ঘোষ

শেষ আপডেট: ৩১ মার্চ ২০২৫ ০৬:৫০
Share
Save

প্রস্তুতকারী কোনও সংস্থাইসরাসরি বাজারে ওষুধ পাঠায় না। বদলে, প্রতিটি রাজ্যের প্রধান শহরে নির্দিষ্ট ‘এজেন্ট’-এর কাছে আসে সেই ওষুধ। তাদের মাধ্যমেই পাইকারি বাজারে ওষুধ যেমন আসে, তেমনই মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে সংস্থার কাছে ফেরত পাঠানো হয়। এই পুরো ‘পথ’-এর মধ্যেই কোথাও অসাধু কারবারিরা থাবা বসাচ্ছে বলেই দাবি কেন্দ্র ও রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলের। অভিযোগ, আর সেই সংক্রান্ত লেনদেনে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা হচ্ছে বেকারদের অ্যাকাউন্ট, যার জন্য তাদের দেওয়া হচ্ছে ভাল কমিশন। এই সব কারণে তাই, প্রস্তুতকারী সংস্থার তালিকাভুক্ত ‘ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং’ (সি অ্যান্ড এফ) এজেন্টদের একাংশও ড্রাগ কন্ট্রোলের আতশকাচের তলায় রয়েছে বলেই খবর।

সূত্রের দাবি, জাল ওষুধের বিষয়ে উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, পুদুচেরি, ওড়িশা, বিহার প্রশাসনকে শনিবার চিঠি পাঠানো হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে। জাল ওষুধের তদন্তে নেমে ওই সমস্ত রাজ্যের বিভিন্ন যোগসূত্র মিলেছে।

সেই সমস্ত বিষয় বিশদে খতিয়ে দেখে, জানানোর জন্য এ রাজ্যের তরফে চিঠিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি, কী ভাবে ওই সমস্ত রাজ্য থেকে বঙ্গে জাল ওষুধ ঢুকছে, সে দিকেও কড়া নজরদারির আবেদন করা হয়েছে।

জাল ওষুধের তদন্ত যত এগোচ্ছে, ততই নতুন ধরনের জালিয়াতির খোঁজ মিলছে বলে জানাচ্ছেন ওষুধ ব্যবসায়ী থেকে ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকরা। পুরোপুরি জাল ওষুধ, মেয়াদের তারিখ বদলের পাশাপাশি, একটি বাক্সে থাকা ১০টি স্ট্রিপের মধ্যে ৭০-৩০ আনুপাতিক হারে মিশে থাকছে জাল ওষুধ। অর্থাৎ প্রতি দু’টি বা তিনটি আসল স্ট্রিপের মাঝে রাখা হচ্ছে হুবহু একই রকমের একটি জাল স্ট্রিপ। তাতেই একটি বাক্সে ১০টির মধ্যে তিনটি জাল ওষুধ থেকে যাচ্ছে। কী ভাবে এটা সম্ভব হচ্ছে, কোথা থেকে ওষুধ বদল হচ্ছে, এখনও তা স্পষ্ট নয় ড্রাগ কন্ট্রোলের কাছেও।

তবে মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ কী ভাবে পুনরায় বাজারে আসছে, তার ধারণা আপাতত স্পষ্ট তদন্তকারীদের কাছে। জানা যাচ্ছে, মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ৯০ দিনের মধ্যে ‘সি অ্যান্ড এফ’ এজেন্টের মাধ্যমে প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছে ফেরত পাঠাতে হয় পাইকারি ব্যবসায়ীদের। কিন্তু ‘সি অ্যান্ড এফ’ এজেন্টদের থেকে আদৌ সব ওষুধ সংস্থার কাছে পৌঁছচ্ছে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। মাঝপথে অন্য দালালের মাধ্যমে জাল-ওষুধের কারবারিদের কাছে তা পৌঁছে গেলেও, সেটিতে নজরদারির অভাব রয়েছে বলেও অভিযোগ। আবার, এ রাজ্যের ওষুধ ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘বেঙ্গল কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট অ্যাসোসিয়েশন’ (বিসিডিএ)-র দাবি, ২০১৭-র ১ জুলাই থেকে জিএসটি চালু হওয়ার পরে, এক দেশ এক মার্কেট ব্যবস্থায় ভিন্‌ রাজ্য থেকে সরাসরি ওষুধ কেনা অত্যন্ত সহজ হয়েছে। করোনা পরবর্তী সময়ে গ্যাস, সুগার, রক্তচাপ, সাধারণ অ্যান্টিবায়োটিকের মতো প্রচুর ব্যবহৃত ওষুধের চাহিদা আরও বেড়েছে। তাতে ছাড়ের প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে গিয়ে পাইকারি এবং বড় মাপের খুচরো ব্যবসায়ীদের একাংশ সরাসরি ওষুধ কিনছেন ভিন্‌ রাজ্যের অজানা-অচেনা সংস্থার থেকে।

সমস্যা তৈরি হচ্ছে সেখানেও। যে সমস্ত পাইকারি বা খুচরো ব্যবসায়ী কলকাতার ‘ক্লিয়ার‌্যান্স অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট’-এর থেকে ওষুধ কেনেননি, তাঁরা মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ ওই এজেন্টের মাধ্যমে ফেরত পাঠাতে পারে না প্রস্তুতকারী সংস্থার কাছে। আবার ভিন্‌ রাজ্যের যে সংস্থার থেকে ওষুধ কিনেছে, সেখানেও ফেরতের ব্যাপারই নেই। ফলে বহু ক্ষেত্রেই ব্যবসায়ীদের একাংশ একেবারে লোকসান করার থেকে, কিছুটা লাভের আশায় দালালের হাতে তুলে দিচ্ছেন ওই সমস্ত মেয়াদ উত্তীর্ণ ওষুধ। সেই দালালের মাধ্যমেই এ রাজ্য তো বটেই, ভিন্‌ রাজ্যেও পৌঁছে যাচ্ছে ওই ওষুধ। এর পরে তারিখ বদল হয়ে পুনরায় সেই জাল ওষুধ চলে আসছে বাজারে।

‘বিসিডিএ’-র সাধারণ সম্পাদক পৃথ্বী বসু বলেন, ‘‘এর জন্যই চেনা-নামী এজেন্টের কাছ থেকে ওষুধ কেনার জন্য বারবার করে সংগঠনের সদস্যের সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু ছাড়ের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে গিয়ে একাংশ না জেনেই জাল ওষুধ দোকানে আনছেন, প্রতারিত হচ্ছেন।’’

ড্রাগ কন্ট্রোল সূত্রের খবর, ভিন্‌ রাজ্যের যে সমস্ত সংস্থা থেকে ওষুধ কেনা হচ্ছে, তাদের লাইসেন্স থেকে জিএসটি, অ্যাকাউন্ট— সবই ভুয়ো। আমতার ঘটনার তদন্তে নেমে সেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয় তদন্তকারীদের সামনে। তাঁরা জানাচ্ছেন, ভিন্‌ রাজ্যের সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরে, পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওয়টস্যাপে পাঠানো হচ্ছে বিল। তাতে দেওয়া থাকছে অ্যাকাউন্ট নম্বর। কিন্তু সেটি সরাসরি সংস্থার নয়। বরং বেকার যুবকদের ১০ থেকে ২০ শতাংশ কমিশন পাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে, তাঁদের নথি ব্যবহার করে ওই সমস্ত অ্যাকাউন্ট খোলা হচ্ছে টাকা লেনদেনের জন্য।

জাল ওষুধ তৈরির কারবারের নেপথ্যে আরও একটি দিক রয়েছে বলে মত ড্রাগ কন্ট্রোলের আধিকারিকদের। জানা যাচ্ছে, বহু প্রস্তুতকারী সংস্থাই অন্য কোনও ছোট সংস্থাকে দিয়ে ওষুধ তৈরি করায়। এর জন্য ওষুধের সাইজ়-সহ ব্র্যান্ডিং, প্যাকেজিংয়ের সমস্ত স্পেসিফিকেশন তুলে দেওয়া হয় ওই ‘থার্ড পার্টি’ বা তৃতীয় পক্ষের হাতে। ফলে সেখান থেকেও নামী ব্র্যান্ডের তথ্য ফাঁস হওয়ার সম্ভাবনা মারাত্মক ভাবে বেশি। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই যে সমস্ত ওষুধ প্রস্তুতকারী সংস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে কিংবা কেন্দ্রীয় ড্রাগ আইন মেনে পরিকাঠামো তৈরিতে ব্যর্থ, তারা জাল ওষুধ তৈরি শুরু করেছে। ড্রাগ কন্ট্রোলের এক তদন্তকারীর কথায়, ‘‘নামী ব্র্যান্ডের তথ্য সহজেই হাতে চলে আসায় অনায়াসে হুবহু একই রকমের জাল ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়া হচ্ছে।’’

কিন্তু এই সমস্ত বিষয় দেখার জন্য কেন্দ্র বা রাজ্য কোথাও সে ভাবে নজরদারি নেই কেন? ‘ইন্ডিয়ান ফার্মাসিউটিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য শাখার সভাপতি মুক্তিপদ রানার কথায়, ‘‘সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেও রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোল কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তাই এত কিছু ধরাও পড়ছে। তবে পরিকাঠামোর আরও উন্নতির প্রয়োজন। নতুন পরীক্ষাগার তৈরির জন্য রাজ্য সরকারকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।’’ প্রশ্ন হল, ড্রাগ কন্ট্রোলের বেহাল পরিকাঠামোর ফাঁক গলেই জাল ওষুধ চক্রের রমরমা বাড়ছে না তো?

(চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Fake Medicines medicines Drug Control

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

এটি একটি প্রিন্ট আর্টিক্‌ল…

  • এমন অনেক খবরই এখন আপনার হাতের মুঠোয়

  • সঙ্গে রোজ পান আনন্দবাজার পত্রিকার নতুন ই-পেপার পড়ার সুযোগ

  • ই-পেপারের খবর এখন শুধুই ছবিতে নয়, টেক্সটেও

প্ল্যান সিলেক্ট করুন

মেয়াদ শেষে আপনার সাবস্ক্রিপশন আপনাআপনি রিনিউ হয়ে যাবে

মেয়াদ শেষে নতুন দামে আপনাকে নতুন করে গ্রাহক হতে হবে

Best Value
এক বছরে

৫১৪৮

১৯৯৯

এক বছর পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।
*মান্থলি প্ল্যান সাপেক্ষে
এক মাসে

৪২৯

১৬৯

এক মাস পূর্ণ হওয়ার পর আপনাকে আবার সাবস্ক্রিপশন কিনতে হবে। শর্তাবলী প্রযোজ্য।