দুর্ভোগ: এ ভাবেই রোগী নিয়ে যেতে হচ্ছে মেডিক্যালে। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক
দাদা সফিউদ্দিনকে নিয়ে উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে এসেছেন জনিরুল ইসলাম। সফিউদ্দিনের শরীরে ডান দিকের অংশ অসাড়। হাঁটতে পারেন না। কিন্তু নিয়ে যাওয়ার জন্য ট্রলি মিলল না হাতের কাছে। বাধ্য হয়েই তাঁকে কোলে করে এক বিভাগ থেকে অন্য বিভাগে নিয়ে গেলেন জনিরুলেরা। একই পরিস্থিতি দুর্ঘটনায় পা জখম হওয়া গোবিন্দ বর্মণকে নিয়েও। তাঁকে পিঠে করে বহির্বিভাগে চিকিৎসা করাতে আনেন পরিমল ঘোষ। অনেক খুঁজেও ট্রলি পাননি।
এনআরএস কাণ্ড নিয়ে সোমবারে আইএমএ-র ডাকা ধর্মঘটে বন্ধ ছিল বহির্বিভাগ। মঙ্গলবার তা খুলতেই চোখের সামনে চলে আসে এই ধরনের ছোটখাট খামতিগুলি। হাসপাতালের এক কর্মী নাম প্রকাশ করতে না চেয়ে বলেন, ‘‘এগুলো তো সাধারণ ব্যাপার। এর থেকেও বড় সমস্যা রয়েছে এই হাসপাতালে।’’
হাসপাতাল সূত্র বলছেও তাই। যত রোগী আসে মেডিক্যালে, তার তুলনায় শয্যা সংখ্যা তার প্রায় অর্ধেক। সূত্রের দাবি, মেডিক্যালে অনুমোদিত শয্যা সংখ্যা ৬৩৩টি। অথচ রোগী থাকে গড়ে ১১০০ জন। ওই সূত্রে জানা গিয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে এখানকার সিটি স্ক্যান যন্ত্রটি খারাপ। মাঝ্যমধ্যেই বিগড়ে যায় এমআরআই পরিষেবা। মুমূর্ষু রোগীকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটে রাখার দরকার হলে জায়গা মেলে না। ভেন্টিলেশনে রাখার দরকার হলে লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। সিটি স্ক্যান করাতে শিলিগুড়ি জেলা হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। রোগীকে ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে বা ওয়ার্ড থেকে পরীক্ষা করাতে নিয়ে যেতে ট্রলি মেলে না। পিঠে করে বা কোলে তুলে নিয়ে যেতে হয়। ডাক্তার ও নার্সদের একাংশের দুর্ব্যবহারও রয়েছে।
হাসপাতাল সূত্রে বলা হচ্ছে, এ সবের ফলেই অনেক সময়ে রেগে যান রোগীর বাড়ির লোক, আর সেই রোষ পড়ে গিয়ে ডাক্তার, নার্সদের উপরে।
ওই সূত্রে বলা হচ্ছে, মেডিক্যাল কলেজের উপরে রোগীর চাপও সাংঘাতিক। রোজই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কয়েকশো রোগীকে ‘রেফার’ করা হয় মেডিক্যালে। তার উপরে নিজের এলাকার রোগী তো আছেনই। হাসপাতাল সূত্রের দাবি, রোজ প্রায় পাঁচ হাজার রোগী আসেন বহির্বিভাগে দেখাতে আসেন। এর সঙ্গে হাজারের উপরে ভর্তি থাকা রোগীকে যোগ করলে সংখ্যাটা সত্যিই উদ্বেগজনক। সূত্রটির কথায়, এর জন্য খাতায়কলমে অবশ্য চিকিৎসক রয়েছেন। ২৮০ জন চিকিৎসক, ১৫০ জন ইন্টার্ন, ৭০ জন হাউস স্টাফ এবং শতাধিক পোস্ট গ্র্যাজুয়েট আছেন। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে এঁদের অনেকেরই দেখা মেলে না বলে অভিযোগ।
পরিকাঠামোগত ভাবে আরও কিছু কাজ করার আছে, মেনে নিচ্ছেন হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ। তাঁদের কথায়, ট্রমা সেন্টার গড়তে ন’বছর আগে প্রক্রিয়া শুরু হয়। অথচ আজও তা চালু হল না। অনেক সময়ই ডায়ালাইসিস ইউনিটের একটা বা দু’টি ঠিক থাকে, বাকিগুলো অকেজো। এমন সব সমস্যায় রোগীদের চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিপাকে পড়তে হয় চিকিৎসকদেরও। হাসপাতালের সুপার কৌশিক সমাজদার বলেন, ‘‘প্রচুর রোগী রোজ হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে আসেন। বিভিন্ন জেলা থেকে ‘রেফার’ হয়েও অনেক রোগী আসেন। রোগীর চাপ তাই বেশি থাকেই। সিটি স্ক্যান চালু বা সিসিইউতে শয্যা বাড়ানোর জন্য বারবার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। সে সব প্রক্রিয়া চলছে। সে সব নিয়ে কিছু সমস্যা থাকে।’’ রোগী অনুপাতে চিকিৎসকও কম বলে তিনি দাবি করেন। ট্রলির সমস্যা মেটাতে কর্তৃপক্ষ উদ্যোগী বলে দাবি করেন।
হাসপাতালের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রত্যন্ত এলাকা থেকে আসা রোগীদের উত্তরবঙ্গ মেডিক্যালে নানা ভাবে দুর্ভোগের শিকার হতে হয়। রক্ত পেতে বা কোনও পরীক্ষার রিপোর্ট দ্রুত করাতে দালালদের খপ্পড়ে পড়ে অনেকেই টাকা নষ্ট করেন। হাসপাতালে চারটি ‘আলট্রাসাউন্ড’ যন্ত্রাংশের মধ্যে দু’টি কাজ করছে। তার মধ্যে একটি আবার মাঝে মধ্যেই অকেজো। চিকিৎসা কী হচ্ছে তা নিয়েও অনেক সময় অন্ধকারে থাকছে রোগীর পরিবার। তাই রোগী মারা গেলে খেপে যাচ্ছে পরিবার।
হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও অভিয়োগ রয়েছে। ওয়ার্ডের মধ্যে রোগীর লোকজন অভাবে ঢুকছে। রোগী পরিষেবা নিয়ে অভিযোগ উঠলে তাই সমস্যা পড়তে হচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy