দুর্যোগকবলিত এলাকা পরিদর্শনে গিয়ে রক্তাক্ত বিজেপির সাংসদ এবং বিধায়ক! গাড়ি করে জখম মালদহ উত্তরের সাংসদ খগেন মুর্মুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে যেতে ‘ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার’ কথা বর্ণনা করলেন শিলিগুড়ির বিধায়ক শঙ্কর ঘোষ। তাঁর আঙুল তৃণমূলের দিকে। নাগরাকাটা থেকে শিলিগুড়ি যেতে যেতে অভিযোগ করলেন, কিছু মানুষ ‘দিদি দিদি’ বলে তাঁদের দিকে তেড়ে যান। প্রথমে গালাগালি এবং তার পর মারধর। বিধায়কের দাবি, গাড়ির সিটের তলায় প্রায় শুয়ে না পড়লে তাঁর মাথা ফেটে যেত।
দুপুর ২টো নাগাদ ফেসবুক লাইভে আসেন শঙ্কর। তখন গাড়িতে তিনি বসে। আতঙ্কের ছাপ চোখেমুখে। পাশের আসনে শুয়ে রয়েছেন মালদহ উত্তরের সাংসদ খগেন। তাঁর পাঞ্জাবিতে রক্তের দাগ। শঙ্কর জানান, প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু করিয়ে শিলিগুড়ি নিয়ে যাচ্ছেন সাংসদকে। দলের কারও সঙ্গে এখনও যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি তাঁর।
ফেসবুক লাইভে বিধানসভায় বিজেপির মুখ্য সচেতক বলেন, ‘‘শিলিগুড়ির দিকে রওনা দিয়েছি আমরা। খগেনদা (মুর্মু) রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছেন। আমাদের আগের গাড়ির একটাও কাচ নেই। আমার সারা শরীর কাচে ভর্তি। প্রাথমিক চিকিৎসা করে এসেছি। খগেনদার অবস্থা দেখুন... ত্রাণ দেওয়ার জন্য খোঁজখবর নিতে গিয়েছিলাম আমরা। একটি বোটে জয়ন্তদা, দীপকদা ছিলেন। একটি বোটে সমীরদারা নদীর অপরপ্রান্তের মানুষের সঙ্গে দেখা করতে যান। আমি খগেনদা এই প্রান্তের লোকজনের সঙ্গে কথা বলছিলাম। সেই সময় কিছু লোক ‘দিদি দিদি’ করে আমার কাছে আসেন। কেন আমরা এসেছি, কী করব এখানে— এই সব জিজ্ঞাসা করে প্রথমে গালাগালি তার পর তারা পিছন থেকে মারধর শুরু করেন। এখন শিলিগুড়ির দিকে রওনা দিয়েছি। ‘রিলিফ’ দিতে এসে দেখুন আমাদের সাংসদের কী অবস্থা করেছে। আমার মাথায় বাটাম চালাতে গিয়েছিল। সিটে বসে পড়েছিলাম।’’
বামনডাঙায় ঢোকার আগে বিক্ষোভের মুখে পড়েন দু’জনে। লাঠি, জুতো নিয়ে তাঁদের উপর চড়াও হন কয়েকশো মানুষ। নদী থেকে পাথর তুলে তাঁদের গাড়ি লক্ষ করে ছোড়া হয়। তাতেই মাথা ফেটে যায় খগেনের। গলগল করে রক্ত ঝরতে থাকে। ধাক্কা দেওয়া হয় শঙ্করকেও। আপাতত দুই নেতাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তবে এখনও এলাকায় জড়ো হয়ে রয়েছেন কয়েকশো মানুষ। কেন্দ্রীয় বাহিনীও এলাকায় মোতায়েন রয়েছে। তাতেও উত্তেজনা কমছে না বলে স্থানীয় সূত্রে খবর।
বৃষ্টি এবং ধসে পাহাড় থেকে তরাই এবং সমতল, উত্তরবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশ ক্ষতিগ্রস্ত। এই অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলি আলাদা আলাদা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলিতে পৌঁছোচ্ছে। পূর্ব ঘোষণা মাফিক সোমবার সকালে শিলিগুড়ি যান বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে বাগডোগরা বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন দার্জিলিঙের সাংসদ রাজু বিস্তা, জলপাইগুড়ির সাংসদ জয়ন্ত রায়, মাটিগাড়া-নকশালবাড়ির বিধায়ক আনন্দময় বর্মণ, ফালাকাটার বিধায়ক দীপক বর্মণ প্রমুখ। ছিলেন খগেন, শঙ্করেরাও। এর পর তাঁরা বিপর্যস্ত বিভিন্ন এলাকার পরিস্থিতি দেখতে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু বামনডাঙায় কাছে শঙ্কর এবং খগেনকে ঘিরে কয়েকশো মানুষ বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। অভিযোগ, এর পর লাঠিপেটা করা হয় বিরোধীদলের দুই জনপ্রতিনিধিকে। ‘গো ব্যাক’ স্লোগান দেওয়া হয়। এমনকি, জুতো ছোড়া হয় বলেও অভিযোগ। খগেনকে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখা যায়। মাথা ফাটে তাঁর। আক্রান্ত হন শঙ্করও।কেন্দ্রীয় বাহিনীর পক্ষেও পরিস্থিতি সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন:
স্বাভাবিক ভাবে এই নিয়ে রাজনৈতিক চাপানউতরের সৃষ্টি হয়েছে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা নিশীথ প্রামাণিক বলেন, ‘‘বিধ্বস্ত উত্তরবঙ্গের পাশে দাঁড়ানোর সময় এটা। দলমত নির্বিশেষে সকলের এগিয়ে আসা উচিত। অর্থাৎ, এ রকম একটা সময়ে রাজনীতি করতে ছাড়ছে না তৃণমূল। সাংসদকে প্রাণে মেরে ফেলার মতো করে আক্রমণ করা হল, এটা মেনে নেওয়া যায় না।’’ দলের সাংসদ এবং বিধায়কের উপর হামলার নিন্দা করেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, ‘‘মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গুন্ডারা পরিকল্পিত ভাবে বিজেপি সাংসদ ও বিধায়কের উপর হামলা চালিয়েছে।’’ যদিও উত্তরবঙ্গের উন্নয়নমন্ত্রী তথা দিনহাটার বিধায়কের প্রতিক্রিয়া, ‘‘কে বলল এই কাজ তৃণমূলের? সাধারণ মানুষ ক্ষিপ্ত হয়ে এই কাজ করতে পারে।’’ পরে তিনি বিবৃতি দিয়ে এ-ও বলেন, ‘‘প্রথমেই আমরা স্পষ্ট করে জানাতে চাই, আমাদের দল কোনো ধরনের হিংসার সমর্থন করে না।আজ যা ঘটেছে, তা সম্পূর্ণ ভাবে বিজেপির নিজের কর্মফল। যখন সাধারণ মানুষ ভয়াবহ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত, তখন বিজেপি নেতারা ১০টির বেশি গাড়ির কনভয় নিয়ে শুধুমাত্র ফোটোশুটের জন্য এলাকায় গিয়েছিলেন, কোনও ত্রাণ ছাড়াই। এতে স্থানীয় মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে পড়েন এবং তার পর এই ঘটনা। বিজেপির দীর্ঘ দিনের অন্যায় এবং মানুষের প্রতি অবহেলার ফল এটা। মানুষকে বঞ্চিত করব, তার পর তাঁদের দুঃসময়ে গিয়ে ফোটো তুলব — এটাই বিজেপির কাজের ধারা।’’