করোনা সংক্রমণ হয়ে রোগী নার্সিংহোমে ভর্তি ছিলেন ১৩ দিন। শারীরিক অবস্থা খারাপ ছিল বলে বেশিরভাগ সময় ছিলেন আইসিইউ-তে। সেই সময়ে তিন জন চিকিৎসক তাঁকে দেখেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর বিলেই। তাঁদের মধ্যে এক জন পালমোলজিস্ট, যিনি ফুসফুস সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। এক জন বিশেষজ্ঞ মেডিসিনের ডাক্তার। তৃতীয় জন ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিটের চিকিৎসক। বিল অনুযায়ী, ওই ১৩ দিনে প্রথম জন রোগীকে দেখেছেন ২৩ বার, দ্বিতীয় জন ২৪ বার এবং তৃতীয় জন দেখেছেন ১৬ বার। তিন জনের বিল মিলিয়ে মোট ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হয়েছে ডাক্তারের ফি বাবদ। আর এখানেই উঠেছে প্রশ্ন।
কারণ, মাটিগাড়ার পরিবহণ নগরের নার্সিংহোমটিতে চিকিৎসা করানো নকশালবাড়ির বাসিন্দা করোনা রোগী ওই যুবকের মা জয়ন্তী দেবীর অভিযোগ, মেডিসিনের চিকিৎসক নিয়মিত দেখলেও পালমোলজিস্ট বা ফুসফুস বিশেষজ্ঞ তাঁর ছেলেকে একেবারেই দেখেননি। মায়ের আরও দাবি, ওই চিকিৎসক জানিয়ে দিয়েছিলেন, রোগীর পরিস্থিতি ভাল নয়, তাই তিনি দেখতে পারবেন না। মায়ের দাবি, পরে ছেলে কিছুটা সুস্থ হলে তাঁর সঙ্গে কথা বলে মা জানতে পারেন, মেডিসিনের চিকিৎসক আইসিইউ’তে তাঁকে নিয়মিত দেখতেন। ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিভাগের চিকিৎসকও কখনও দেখেছেন। কিন্তু অন্য কোনও চিকিৎসক তাঁকে দেখেছেন বলে মনে করতে পারছেন না ছেলে। জয়ন্তীদেবীর কথায়, ‘‘এক জন চিকিৎসক তো নিজেই বলেছিলেন, আপনার ছেলেকে আমি আর দেখছি না। তা হলে তিন জন চিকিৎসকের নাম করে কেন এ ভাবে মোটা টাকা বিল করা হয়েছে, বুঝতে পারছি না?’’
নার্সিংহোমের ম্যানেজার তাপস দে-র দাবি, ‘‘আইসিইউ’তে রোগী ছিল। রোগীকে দেখার জন্য ওই তিন জন চিকিৎসকের বোর্ড ছিল। বুকের পরিস্থিতি পালমোনলজিস্টকে নিয়মিত দেখতে হচ্ছে। ক্রিটিক্যাল কেয়ারের যিনি চিকিৎসক, তিনি তো দেখবেনই। মেডিসিনের চিকিৎসক প্রতিদিন কার্যত দু’বার করে দেখছেন। না হলে রোগীর পরিস্থিতি যে কোনও সময় খারাপ হতে পারে।’’
এমন অভিযোগ মাটিগাড়ার ওই নার্সিংহোমেরই শুধু নয়, শহরের বেশ কিছু নার্সিংহোমের বিরুদ্ধেই উঠেছে। রোগীর পরিবারেরা দাবি করেছেন, করোনা আক্রান্তদের হাসপাতালে ভর্তি করানোর পরে এক ধরনের চক্রের মধ্যে পড়তে হচ্ছে তাঁদের। রোগীর শারীরিক অবস্থা যত খারাপ, তার ক্ষেত্রে বিল তত বেশি। এ কথা শিলিগুড়ির স্বাস্থ্যমহলেরই অনেকে মেনে নিচ্ছেন। তাঁদের বক্তব্য, রোগীর বাড়ির লোককে বলে দেওয়া হচ্ছে কোভিডের চিকিৎসার জন্য মেডিক্যাল বোর্ড গড়া হয়েছে। একজন এমডি (মেডিসিন বা ইন্টারনাল মেডিসিন), একজন ইএনটি, পালমোনলজিস্ট থাকছেন। এর সঙ্গে যোগ হচ্ছেন আরএমও, ক্রিটিক্যাল কেয়ার বিশেষজ্ঞরা। প্রত্যেকের নামে প্রতিদিন অন্তত দু’বার করে ফি দেখানো হয় বলেও অভিযোগ। আর করোনা রোগীর যদি কোমর্ডিবিটি থাকে, তা হলে কথাই নেই৷ ভর্তির সময় রোগীর স্বাস্থ্যের ইতিহাস জেনে নিয়ে কার্ডিয়োলজিস্ট, নেফ্রোলজিস্ট, গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট, সাইক্রিয়াটিস্ট, এনডোক্রিনোলজিস্ট মতো বিশেষজ্ঞরা চিকিৎসায় নেমে পড়েন। সকলের ক্ষেত্রেই মোটা টাকা ফি৷ ওই চিকিৎসকদের পরামর্শের কথা বলে একাধিকবার এক টেস্ট করানো হয় বলেও অভিযোগ।
মাটিগাড়ার নার্সিংহোমটির দাবি, তাঁরা বিলে কিছু টাকা ছাড় দিয়েছেন। যদিও সেটা বিলে উল্লেখ করা হয়নি। কিন্তু উল্টো দিকে অভিযোগ, বিলে এমন কিছু ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা ধরা আছে, যাতে সেগুলি থেকে সহজেই ছাড় দেওয়া যায়। মোট বিল হয়েছে ৪ লক্ষ ৭৩ হাজার টাকার কিছু বেশি। অনেক ভুক্তভোগীরই বক্তব্য, পাঁচ লাখ টাকার স্বাস্থ্য বিমা মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের কত জন করতে পারে? প্রশ্ন উঠেছে, যে রোগী আশঙ্কাজনক এবং দীর্ঘসময়ের জন্য ভর্তি থাকছেন, তাঁর ক্ষেত্রে কেন প্যাকেজ দেওয়া হচ্ছে না? হৃদযন্ত্রে অস্ত্রোপচারের ক্ষেত্রেও এখন যেখানে প্যাকেজ চালু হয়েছে, সেখানে করোনা চিকিৎসাতেই বা তা হবে না কেন, এই প্রশ্ন করছেন রোগীর পরিবারের লোকজন।
ফাইট করোনার পক্ষে অনিমেষ বসু বলেন, ‘‘করোনার হলে বিপদ তো আছেই। কিন্তু তার থেকেও বড় বিপদ, এই নার্সিংহোমগুলির বিল। এই বিল চোকাতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে কিছু পরিবার।’’
এই নিয়ে স্বাস্থ্য দফতর কী ব্যবস্থা নিচ্ছে? দার্জিলিং জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক প্রলয় আচার্যের কথায়, ‘‘বিল নিয়ে নানা অভিযোগ পাচ্ছি। তা দেখা হবে।’’