E-Paper

ভাষা-বিভ্রাটে দুই কন্যা, ভরসা ইশারাই

ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে অন্য সবাইকে কথা বলতে দেখে ছোট মেয়েটিও হাসিমুখে অনেককে অনেক কিছু বলে গেল। কিন্তু সে কথা বুঝল না কেউ।

অনির্বাণ রায়

শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ ০৮:০৩
picture of sign language.

বেশ কয়েক দিন ধরেই অনুভব হোমে চলছে এই ভাষা-বিভ্রাট। প্রতীকী ছবি।

শুন্ডি রাজার দরবারে গুপি-বাঘা রাজামশাইকে জানিয়েছিলেন— ‘মোদের নিজের ভাষা ভিন্ন আর ভাষা জানা নাই’। সে কথা শুনে রাজামশাইয়ের মুখে নির্মল হাসি ছড়িয়ে পড়তে দেখা গিয়েছিল রুপোলি পর্দায়। গুপি-বাঘার ‘নিজের ভাষা’য় গান শুনে মোহিত হয়ে তাল ঠুকেছিলেন রাজা। ভাষা দিবসের সকালে জলপাইগুড়ির অনুভব হোমের হলঘরে অবিকল যেন সেই দৃশ্য। সাত বছরের একটি মেয়ে কী বলছে, কেউ ঠাহর করতে পারছেন না। কী ভাষায় কথা বলছে, তাও বুঝতে পারা যাচ্ছে না।

বেশ কয়েক দিন ধরেই অনুভব হোমে চলছে এই ভাষা-বিভ্রাট। দিনদশেক আগে হোমে আসা দু’টি মেয়ের বাড়ি যে উত্তরপ্রদেশের বাসি শহরে, সে কথা জানেন হোম কর্তৃপক্ষ। কিন্তু সেখানকার কোন ভাষায় মেয়েগুলি কথা বলছে, বোধগম্য হচ্ছে না কারও। দু’টির মধ্যে যে বড়, সে ভাঙা হিন্দিতে তবু নাম-ঠিকানা বলতে পারে, হিন্দি কিছুটা বুঝতেও পারে। ছোট বোনটি হিন্দি বোঝেও না, বলতেও পারে না। নিজের ভাষা ভিন্ন তার অন্য কোনও ভাষা জানা নেই আর তার নিজের সেই ভাষা হোমের কেউ জানেন না।

নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে এই দু’টি মেয়েকে কিছু দিন আগে রেল পুলিশ উদ্ধার করে জলপাইগুড়ির অনুভব হোমে পাঠায়। ওরা দুই বোন। উত্তরপ্রদেশের কোনও স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠে পড়েছিল। এক জনের বয়স আট, আরেক জনের চোদ্দো। হোমের সুপার ডালিয়া মিত্র বলেন, “ওদের কথায় কিছুটা ভোজপুরী টান রয়েছে বলে মনে হয়। কিন্তু আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। ইশারায় কথা বলছি।’’ ভাত, তরকারি, মাছ খেতে চায় না দুই বোন। রুটি দিলে ফিরিয়ে দেয়। ফল এগিয়ে দিলে তবু দু’এক টুকরো খায়। কিন্তু তাতে পেট ভরে কি? কখনও কখনও মেয়ে দু’টি কিছু চায় বলে মনে হয় হোমের লোকজনের। কিন্তু কী চাইছে, বোধগম্য হয় না। হোমের কর্মীরা ইশারায় জানতে চান, ওরা কী খেতে চায়? তার উত্তরে ছোট মেয়েটি হেসে হেসে কিছু একটা বলেও। কিন্তু কী বলে, বোঝা যায় না। হোমের সুপার বললেন, “ইশারায় খাওয়ার ভঙ্গি করে দেখালে ওরা কোনও খাবারের কথা বলে। কিন্তু কী বলে, বুঝতে পারি না। হিন্দিভাষীদের ডেকে এনে শুনিয়েছি। তাঁরাও বুঝতে পারেননি।’’

এই সমস্যার খানিকটা সমাধান হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের সকালেই। মেয়ে দু’টির তথ্য উত্তরপ্রদেশের শিশুকল্যাণ দফতরে পাঠানো হয়েছিল। সেখান থেকে খবর পেয়ে মেয়ে দু’টির পরিবারের সদস্যেরা এ দিনই হোমে আসেন। তাঁরা মোটা মুটি হিন্দি বলতে পারেন। তাঁরা জানান, এই দুই বোন নিজেদের অঞ্চলের ভাষাতেই কথা বলছে। তবে সে ভাষার নির্দিষ্ট নাম কী, তা জানা যায়নি পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকেও। তাঁরা হোম কর্তৃপক্ষকে জানান, ছোট মেয়েটি গুঁজিয়া, খুরমা, নিমকি খেতে অভ্যস্ত। ভাষা বুঝতে পেরে হোমের তরফে সে সবের ব্যবস্থা করা হয়। দুই মেয়ে বেজায় খুশি।

ভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে অন্য সবাইকে কথা বলতে দেখে ছোট মেয়েটিও হাসিমুখে অনেককে অনেক কিছু বলে গেল। কিন্তু সে কথা বুঝল না কেউ। অনেকটা রবিঠাকুরের গানের মতো— ‘তোমার ভাষা বোঝার আশা দিয়েছি জলাঞ্জলি’! তবে হাসির নিজস্ব এক অমোঘ ভাষা আছে। তাই মেয়েটির মুখের হাসির আলোই ছড়িয়ে পড়ল, মিশে গেল বাকিদের নির্মল হাসিতে।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Girl International Mother Language Day

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy