Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

আমি ছোট নেতা, অভিমানী অশোককে দেখল শিলিগুড়ি

তাঁকে ঘিরেই অনুষ্ঠানের আয়োজন, অথচ তিনি এলেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধঘণ্টা দেরিতে। তাঁর বক্তব্যের অপেক্ষায় ছিলেন সকলে, অথচ তিনি বললেন মাত্র সাড়ে ৬ মিনিট। মাইক টেনে চেয়ারে বসেই বক্তৃতা করলেন। ঘনিষ্ঠরা দাবি করলেন, এ সবই তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ।

পুরসভায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অশোক ভট্টাচার্য। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

পুরসভায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে অশোক ভট্টাচার্য। ছবি: বিশ্বরূপ বসাক।

নিজস্ব সংবাদদাতা
শিলিগুড়ি শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০২:৩০
Share: Save:

তাঁকে ঘিরেই অনুষ্ঠানের আয়োজন, অথচ তিনি এলেন নির্ধারিত সময়ের প্রায় আধঘণ্টা দেরিতে।

তাঁর বক্তব্যের অপেক্ষায় ছিলেন সকলে, অথচ তিনি বললেন মাত্র সাড়ে ৬ মিনিট। মাইক টেনে চেয়ারে বসেই বক্তৃতা করলেন। ঘনিষ্ঠরা দাবি করলেন, এ সবই তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। এমনকী টেবিলে থাকা সংবাদমাধ্যমের ‘বুম’ এবং ‘অন’ ক্যামেরার সামনেই বলে ফেললেন, ‘‘আমি ছোট নেতা। শিলিগুড়ির নেতা। বড় নেতা নই। কলকাতায় থাকলে বড় নেতা হতে পারতাম।’’ এই লুকিয়ে রাখা অভিমান প্রকাশ্যে উগরে দেওয়াটাও তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ।

শুক্রবার দুপুরে শিলিগুড়ির পুরসভার সভাকক্ষে এমনই ‘অচেনা’ মেয়রকে দেখলেন কাউন্সিলর, পুরসভার কর্মী থেকে বামপন্থী শাখা সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। শিলিগুড়ি বিধানসভা আসনে জেতায় এ দিন জোট প্রার্থী তথা মেয়র অশোক ভট্টাচার্যকে সংবর্ধনার অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিলেন বাম কাউন্সিলর, সহ পুরসভার কর্মী সংগঠনের সদস্যরা। সকাল থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়, ভিড়ে উপচে পড়ে সভাঘর, সকলেরই হাতে নানা আকারের ফুলের তোড়া। ভিড়, ফুলে আয়োজনে ত্রুটি ছিল না, তবু বারবারই যেন ছন্দপতন ঘটেছে সভাঘরে। গায়ে পাটভাঙা জামা, মাথায়-কপালে এখনও গত বৃহস্পতিবারের লাল আবিরের হালকা আভা, কিন্তু অশোকবাবুর মুখ গম্ভীর। ফুলের তোড়া হাতে তুলে দেওয়ার সময় ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে হেসেছেন বটে, কিন্তু ফ্ল্যাশবাল্বের ঝলকানি থাকলেই হাসি উধাও হয়ে চোয়াল শক্ত হয়েছে হয়েছে সদ্য বিধানসভা জয়ের সংশাপত্র পাওয়া অশোকবাবুর। নিজে জিতেছেন বটে চোদ্দ হাজারের বেশি ভোটে। শিলিগুড়ির মহকুমার অন্য দুই আসন মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি এবং ফাঁসিদেওয়াতেও তৃণমূলকে হারিয়ে জোট প্রার্থী জিতেছেন। তবু স্বস্তিতে নেই ‘শিলিগুড়ি মডেলে’র জনকের।

গত বৃহস্পতিবার ভোটের ফল প্রকাশের পর থেকেই বিরোধীরা কটাক্ষ করতে শুরু করেছে, উত্তরবঙ্গ তো বটেই গোটা রাজ্যেই মুখ থুবড়ে পড়েছে শিলিগুড়ির ‘মডেল’। এমনকী সিপিএম তথা বাম নেতাদের অনেকেই বলছেন, ‘‘ওসব মডেল-টডেল চলে না।’’ সে সব কানে পৌঁছেছে অশোকবাবুর। নিজের দলের অনেক নেতার মন্তব্য অভিমান বাড়িয়েছে। তাই নিজের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানেও ‘শিলিগুড়ি মডেলে’র প্রসঙ্গ এনেছেন। বলেছেন, ‘‘একটা কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সম্প্রতি রাজ্য এবং দেশের রাজনীতিতিতে বারবার শিলিগুড়ির প্রসঙ্গ এসেছে। এক বছরের মধ্যে পরপর তিনটি ভোটে একটি রাজনৈতিক শক্তির (তৃণমূল) অপ্রতিরোধ্য গতি আমরা রুখে দিয়েছি। এটাকে ছোট করে দেখলে হবে না।’’ গত বছরের শিলিগুড়ি পুরভোটে তৃণমূলের বিরুদ্ধে বুথস্তরে সব বিরোধী দলের কর্মীদের জোট বাঁধার ডাক দিয়েছিলেন অশোকবাবু। শিলিগুড়ি পুরবোর্ড গঠন করে বামেরা। তৃণমূলকে রুখতে বিরোধী জোটের এই লাইন-ই রাজ্য রাজনীতিতে ‘শিলিগুড়ি মডেল’ নামে চর্চিত হয়। গত বছরই শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদ ভোটেও একই লাইনে জয় পায় বামেরা, পরাজিত হয় তৃণমূল। তখন থেকেই রাজ্যেও তৃমমূলকে ঠেকাতে ‘শিলিগুড়ি মডেল’ তুলে ধরা শুরু হয় বাম এবং কংগ্রেসের অন্দরে।

গত বৃহস্পতিবার ভোট গণনার পরে শিলিগুড়ি ‘মডেল’ শুধু শিলিগুড়িতেই সীমাবদ্ধ বলে বামেদের অন্দরেই চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছে। সে কারণেই হয়ত সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অশোকবাবুকে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের বক্তবে ‘শিলিগুড়ি মডেলের’ যৌক্তিকতা ব্যখ্যা করেন।

হয়ত সে কারণেই অব্যবহিত পরে সাংবাদিক বৈঠকে ‘শিলিগুড়ি মডেল’ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে অশোকবাবু দাবি করেন, ‘‘এই কথা তো আমি বলিনি, মিডিয়া বলেছে। আমরা একবছরে তিন তিনবার একটি রাজনৈতিক দলের গতিকে প্রতিহত করতে পেরেছি। আমাদের অনেকেও নানা কথা বলছে। তবে এটা তো ঘটনা আমরা এখানে করে দেখিয়েছি।’’ হঠাৎই গলার স্বর খাদে নামে তাঁর। ভরা সাংবাদিক বৈঠকে বলেন, ‘‘কলকাতায় থাকলে বড় নেতা হতে পারতাম।’’ উঠে দাঁড়ান চেয়ার ছেড়ে। এগিয়ে যান মেয়রের চেম্বারের দিকে।

নিজের জয়ের পরদিন সংবর্ধনা সভাতে অশোকবাবুকে কখনও চিন্তিত, কখনও উদ্বিগ্ন কখনও আবার আহত মনে হয় সহকর্মীদের। এবং অভিমানীও।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE