স্পষ্ট চোখের সামনে ভেসে বেড়ায় সেই সবদিন। তখন আমি নবম শ্রেণির ছাত্র। তখন লিয়াকত আলি পাকিস্থানের প্রধানমন্ত্রী। চারপাশ থেকে খবর আসছে আমাদের মাতৃভাষা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আমি, হাসমত থেকে শুরু করে জনা কয়েক বন্ধু নেমে পড়লাম রাস্তায়।
ছোট ছোট সভা-মিটিং শুরু হল। এই করতে একদিন আমরা ঠিক করলাম বড় মিছিল হবে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা টাঙ্গাইলের গোপালপুর থেকে রওনা হলাম নন্দনপুরের নেতৃত্বে। হাজার হাজার মানুষ মিছিলে পা মেলাল। একটাই স্লোগান, “আমার ভাষা বাংলা ভাষা।” চারদিকে মুখরিত হয়ে উঠল। নন্দনপুরে পৌঁছতেই আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল শ’য়ে শ’য়ে পুলিশ। শুরু হল বচসা। তাঁদের কঠোর মূর্তি দেেখ অনেকেই পালিয়ে গেলেন। আমরা পালাইনি। আমি, হজরত- সহ তিনজন। ৯২ (খ) ধারায় পুলিশ গ্রেফতার করল। তার পর এই জেল, সেই জেল করে ছয় মাস কাটাতে হয় আমাদের। ছয় মাস পরে বিচারক ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন। জেল থেকে বেরিয়ে পড়াশোনা করেছি সেখানেই। গোপালপুর হাইস্কুল থেকে বেরিয়ে আনন্দমোহন কলেজে পড়াশোনা করেছি।
দেখতে দেখতে কেমন করে সময় চলে যায়। কিন্তু, আমরা ভুলতে পারি না সেই ভাষা শহিদ বরকত, জব্বারদের। আমাদের বাড়ি ছিল চন্দবাড়ি গ্রামে। আমরা দুই ভাই। চার বোন। সবাই পড়াশোনা করে শিক্ষিত হয়েছি। ছোট বয়স থেকেই ভাষার প্রতি আমার অগাধ ভালবাসা। পড়াশোনার বাইরেও নিজস্ব লেখালেখির খুব ইচ্ছে ছিল বরাবর। স্কুলে শিক্ষকদের ক্লাস নিয়মিত করেছি। পড়াশোনার প্রতি টান সবাই ভালবাসত। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকেই তাই নজর সেই দিকেই ছিল।
আমাদের গ্রাম থেকে অবশ্য ঢাকা ছিল বহুদূর। তাই সেখানে ঠিক কী ঘটছে তা জানতে আমাদের সময় লাগত অন্ততপক্ষে দুই থেকে তিন দিন। যেদিন মানে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যেদিন গুলি করা হয় বরকতদের, তখনও আমরা তা জানতে পারিনি। দু’দিন পরে সেই খবর পৌঁছয় আমাদের কাছে। সেদিন মনে আছে গোটা গ্রাম স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলে। এক তীব্র যন্ত্রণার সঙ্গে ক্ষোভ দানা বেঁধেছিল প্রত্যেকের মনে। আমরা আর কেউ চুপ করে বসে থাকতে পারিনি। রাস্তায় নেমে যাই সবাই। আমরা কয়েকজন সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছি। লড়াই হয়েছি। পিছিয়ে আসিনি। কলেজ পাশ করার পরে সেই প্রিয় জন্মভূমিতেই খাদ্য সরবরাহ দফতরে একটি চাকরিতে যুক্ত হই। পরে আরও কিছু ঘটনাক্রমের মধ্যে দিয়ে দেশ ছাড়তে হয়।
১৯৬৪ সালে ওই দেশ ছেড়ে চলে আসে এ-দেশে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে সমাজকল্যাণ দফতরে নতুন চাকরিতে যোগ দিই। সেই থেকে কোচবিহারেই আছি। এখন বয়স হয়েছে ৭৮। মাঝে মাঝেই অনেক কিছু ভুলে যাই। অনেকের নামও ভুলে যাই, ভুলে যাই ঘটনার কথাও। আমার সহধর্মিনী আলোকমালা আমাকে মনে করিয়ে দেন অনেক কিছু। লেখালেখি ছাড়িনি। কোচবিহারের ইতিহাস নিয়ে বই লিখেছি। ডুয়ার্স থেকে কাশ্মীরও আমার লেখায় উঠে এসেছে। এ বারে লিখতে ইচ্ছে করছে ভাষা আন্দোলনের সেই স্মৃতি নিয়ে। ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে রয়েছে, সেই মাটিতে। হয়তো হবে না, জানি। পরবর্তী প্রজন্ম যাতে নিজের ভাষাকে ভালবাসতে জানে, তাঁদের উদ্দেশ্যেই লিখে যাব একটি বই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy