E-Paper

নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্টি এবং আমাদের শৈশব 

সত্তরের শেষে বা আশির দশকের শুরুর দিকে শৈশব ছিল অন্যরকম। টিভি তখনও ঘরে-ঘরে আসেনি।

দেবরাজ রায় চৌধুরী

শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০২৫ ০৮:৫৫
নারায়ণ দেবনাথ।

নারায়ণ দেবনাথ।

মনে পড়ে সেই সব শৈশব? হলুদ হয়ে যাওয়া পাতার ভিতর থেকে উঁকি দেওয়া চরিত্রগুলি? স্মৃতির পটে ভেসে ওঠে হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে-ফন্টে, কেল্টু আর বাঁটুল সঙ্গে সেই বিচ্ছু দুটোর মুখ। মনে পড়ে, হাঁদা-ভোঁদার পিসেমশাই বা নন্টে-ফন্টের সুপারিন্টেনডেন্টকে। যাঁর হাত ধরে ওই চরিত্রগুলি আমাদের মনে গেঁথে গিয়েছে, সেই স্রষ্টা নারায়ণ দেবনাথের (১৯২৫-২০২৫) এই বছর একশো পূর্তি। গত সপ্তাহে নারায়ণ দেবনাথের শতবর্ষের জন্মদিন পালিত হল।

সত্তরের শেষে বা আশির দশকের শুরুর দিকে শৈশব ছিল অন্যরকম। টিভি তখনও ঘরে-ঘরে আসেনি। কম্পিউটার বা মোবাইল তো ছিলই না। আমাদের সরল শৈশব ছিল আদ্যোপান্ত দেশীয়। মাঠ, মাটি আর গল্পের বই বা ম্যাগাজ়িনের পাতায়-পাতায় ছড়ানো অপার বিস্ময়। এক অফুরান মুগ্ধতা পেতাম নারায়ণ দেবনাথের ছবি-লেখায় সৃষ্ট জাদু-জগতে। সেই সব অমলিন দৃশ্য আর ধ্বনি যা বাংলা তো বটেই যে কোনও সাহিত্যেই বিরল। যেখানে কেউ নিশ্চিন্তে নাক ডাকে ‘ফোঁররর....ফৎ...’ শব্দে, কেউ এক নিঃশ্বাসে ‘গুল্লুস’ শব্দে সাবাড় করে এক বয়াম মোরব্বা (হায়! এই প্রজন্ম হয়তো বয়ামও জানে না, মোরব্বাও চাখেনি)। যেখানে হাতি এক শুঁড় জল কারও মুখে ছেটালে শব্দ বেরিয়ে আসে ‘আগ্লাহ’, যেখানে ‘ইরররক’ শব্দে কারও পিছলে যায় পা, ‘ওকস’ শব্দে চমকে ওঠে কেউ, যেখানে ‘ইয়ুঁক’ শব্দে কেউ উপরে উঠে গিয়ে ‘গুদুম’ শব্দে নীচে আছাড় খায়।

এমন অসংখ্য উদাহরণ এখনও দিব্যি ধরা আছে স্মৃতিতে। শেষ দৃশ্যে ঊর্ধ্বশ্বাসে পালানো হাঁদার দিকে তেড়ে যাচ্ছেন পিসেমশাই আর গালাগাল করে বলছেন ‘ওরে অলম্বুষ পালাবি কোথায়...?’ না, অলম্বুষ শব্দের মানে সে দিনও জানতাম না আজও জানি না। কিন্তু তাতে এক চিলতেও মজায় টান পড়েনি। আজকে ‘হতচ্ছাড়া’ ‘মর্কট’, ‘বেল্লিক’ ইত্যাদি বুলিগুলিও বেমালুম গায়েব। তবু স্মৃতিতে তাদের ঝাঁঝ কিন্তু ছিটেফোঁটাও কমেনি। ‘বাঁটুল দি গ্রেটের’ দুই খুদে শয়তান নিজেদের স্যাঁঙাৎ বলে সম্বোধন করত। অপরাধের সঙ্গী বোঝাতে স্যাঁঙাৎ শব্দটা কতটা অমোঘ, পরে উঁচু ক্লাসে উঠে তা বুঝতে পারি। যখন আমরাও স্কুলে খানিক দুষ্কর্ম করার আগে নিজেদের স্যাঁঙাৎ বলে ডাকতাম। এত বছর পার করেও সে অভ্যেস টিকে আছে আজও, ওয়টস্যাপে হঠাৎ ঝলকে ওঠে বার্তা— কী স্যাঁঙাৎ, দেখা হবে না কি আজ?

এত বছর পার করে এটাও বুঝতে পারি বাঁটুল, হাদাঁ-ভোদা, নন্টে-ফন্টে, কেল্টুদা বা সেই বিচ্ছু দুটো এদের কারওই বাবা-মার দেখা মেলে না। এটা নারায়ণ দেবনাথ হয়তো সচেতন ভাবেই করেছেন। যাতে চরিত্রগুলির প্রতি শিশু মনে একটা আলাদা সহানুভূতি তৈরি হয়। তার সঙ্গে বাবা-মার উপরে অতিনির্ভরতা যা এই সময় আরও বাড়ছে, তা যেন কিছুটা কমে। তবে এর পরেও আমার কলেজ-পড়ুয়া কন্যার কমিকসগুলির উপরে অভিযোগ রয়েছে, কারণ এতে কোনও মেয়ে চরিত্র নেই।

দুনিয়া পাল্টে গিয়েছে, আমূল বদলে গেছে ধ্যান-ধারণা। তবুও আমাদের মনে নারায়ণ দেবনাথ নির্মিত জাদু-জগতের প্রতি ভাললাগা একটুও কমেনি।

শিক্ষক, মালদহ পলিটেকনিক

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

North Bengal

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy