E-Paper

নয়া প্রজন্মের জন্য চাই প্রযুক্তি-বান্ধব গ্রন্থাগার

সমাজমাধ্যমে ‘রিলস’ বা ‘ভিডিয়’ প্ল্যাটফর্মগুলি সাময়িক বিনোদনের এক নতুন মাধ্যম তৈরি করেছে।

সাহানুর হক

শেষ আপডেট: ১৬ জুলাই ২০২৫ ০৮:৫১
—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

—প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।

একবিংশ শতাব্দীর আধুনিক ডিজিট্যাল যুগে মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তা উল্কাগতিতে ধেয়ে আসছে। এক সময় যে সব তরুণ-তরুণী অবসরে গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়তে ভালবাসতেন, জ্ঞানের খোঁজে পাতা উল্টাতেন, আজ তাঁদের অধিকাংশই ঘণ্টার পর ঘণ্টা সমাজমাধ্যমে ‘রিলস’ বা ‘শর্ট ভিডিয়ো’ দেখে কাটিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রবণতা যে শুধুই তাঁদের আচরণগত তা নয়, বরং এটি মনস্তত্ত্ব, শিক্ষা এবং সমাজের দৃষ্টিকোণ থেকেও ভীষণ সংবেদনশীল একটি সঙ্কেত।

সমাজমাধ্যমে ‘রিলস’ বা ‘ভিডিয়’ প্ল্যাটফর্মগুলি সাময়িক বিনোদনের এক নতুন মাধ্যম তৈরি করেছে। ১৫–৩০ সেকেন্ডের চটকদার, গ্রাফিক্স-ভিত্তিক ভিডিয়ো দ্রুত মনোযোগ কাড়ে এবং আসক্তি তৈরি করে। এতে নতুন প্রজন্মের ধৈর্য কমে যাচ্ছে, দীর্ঘ পাঠ্যবস্তু বা গভীর ভাবনার প্রতি তাঁদের আগ্রহও কমে যাচ্ছে। গ্রন্থাগারের মতো ধীর, নীরব ও একাগ্র পরিবেশে সময় কাটানোর মানসিকতা দিন দিন হারিয়ে ফেলছেন তাঁরা।

এই পরিবর্তনকে একেবারে নেতিবাচক বলা ঠিক হবে না। প্রযুক্তির ব্যবহার, তথ্যের সহজলভ্যতা এবং দ্রুত শেখার কিছু ভাল দিকও রয়েছে। সমাজমাধ্যমে অনেক বিষয় বর্তমান দিনে শিক্ষামূলক, বিজ্ঞানের আবিষ্কার, ইতিহাসের তথ্য বা আত্ম-উন্নয়নের উপায়সমূহ তুলে ধরে থাকে। কিন্তু সমস্যা হল, এই ধারাক্রমে বই পড়ার অভ্যাস, মনোযোগ ও চিন্তাশীলতা হারিয়ে যাচ্ছে নবপ্রজন্মের অনেকের মধ্যেই। এক ঘণ্টার পাঠ্যবই পড়ার চেয়ে ৩০ সেকেন্ডের ‘রিলস’ আজ অনেক বেশি আকর্ষণীয় তাঁদের কাছে। প্রসঙ্গত তাঁদের এমন ভাবনার ব্যবধানে গভীরতা কতটুকু?

গ্রন্থাগার শুধু বই পড়ার জায়গা নয়। চিন্তা, গবেষণা ও আত্ম-উন্নয়নের একটি নিঃশব্দ প্ল্যাটফর্ম। সেখানে সময় কাটানো মানে নিজের মন ও জ্ঞানের সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপন করা। বই পাঠের অভ্যাস তরুণদের যেখানে ভাষাজ্ঞান, বিশ্লেষণক্ষমতা ও সহনশীলতা গড়ে তোলে, সেখানে ‘রিলস’ বা ‘শর্ট ভিডিয়ো’ তা কখনও দিতে পারে না। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রন্থাগার-বিমুখতা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি দ্রুতগতিসম্পন্ন অন্তঃসারশূন্য জগতের দিকে ঠেলে দিচ্ছে নিয়মিত। একটি তথ্য অনুযায়ী, এ দেশে প্রায় ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ তরুণ-তরুণী প্রতিদিন ঘন্টার পর ঘন্টা রিলস দেখে সময় ব্যয় করে থাকেন। সেই তুলনায় তাঁদের শতকরা ২০-৩০ জন গ্রন্থাগারে গিয়ে বই পড়েন।

তবে এর পিছনে কারণও রয়েছে। অনেক গ্রন্থাগার এখনও পুরনো কাঠামো ও পদ্ধতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আধুনিক প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে হলে গ্রন্থাগারও হতে হবে প্রযুক্তি-বান্ধব। ই-লাইব্রেরি, অডিয়ো-বুক, ডিজিট্যাল কনটেন্ট, কেরিয়ার গাইডেন্স ও ‘ইন্টারেক্টিভ’ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে জেলা গ্রন্থাগার থেকে গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলিতেও। শুধু ‘বই পড়ো’ বলে নয়, বরং ‘কেন তারা পড়বে’ তা বোঝানোর দায়িত্ব এক জন সুযোগ্য গ্রন্থাগারিক থেকে শিক্ষক ও অভিভাবক মহলেও নিতে হবে।

তরুণ প্রজন্মের সমাজমাধ্যমে আসক্তি এবং গ্রন্থাগার-বিমুখতা নিছক অভ্যাসগত পরিবর্তন নয়, বরং এটি একটি সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানসিক রূপান্তরও। আমাদের প্রয়োজন এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখা। সুতরাং রিলস-এর গতির সঙ্গে গ্রন্থাগারের গভীরতাকেও কি যুক্ত করা যায় না? ‘রিলস’ যদি হতে পারে বিনোদনের পথ, তবে গ্রন্থাগার কি হতে পারে না জীবনের মানসগঠনের মঞ্চ? তাই নতুন প্রজন্মকে বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট করতে হলে শুধু সমালোচনা নয়, বরং যুগোপযোগী উদ্যোগ এবং নতুন চিন্তার প্রয়োগই হাতিয়ার হতে পারে। ভবিষ্যতের আলোড়নে সেটিই হবে সঠিক দিশা।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Siliguri

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy