E-Paper

যত্রতত্র হোটেল-রিসর্ট, বনাঞ্চল ঘিরে লুটেপুটে খাওয়ার শিল্প

অবৈধ ভাবে গাছ কাটার দৌলতে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অনেক জায়গা কার্যত ফাঁকা হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে জলদাপাড়া, গরুমারা, বৈকুণ্ঠপুর বা মিরিকেও।

পার্থ চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২১ অক্টোবর ২০২৫ ০৯:০৭
গরুমারার জঙ্গল থেকে জলঢাকা নদীর জলে ভেসে গিয়েছিল গন্ডার। কোনওক্রমে পারে উঠেছিল ময়নাগুড়ির আমগুড়িতে।

গরুমারার জঙ্গল থেকে জলঢাকা নদীর জলে ভেসে গিয়েছিল গন্ডার। কোনওক্রমে পারে উঠেছিল ময়নাগুড়ির আমগুড়িতে। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক।

বর্ষায় নদীতে জল বাড়লেই বড়-বড় মাছ ভেসে যেতে দেখেছেন জাহির মিয়াঁ। কিন্তু সাম্প্রতিক দুর্যোগের পরে বাড়ি লাগোয়া শিলতোর্সা নদীর (‌তোর্সার স্থানীয় নাম) দিকে তাকিয়ে তাঁর চোখ কপালে। আলিপুরদুয়ারের শিলবাড়ি ঘাটের পূর্ব পাড়ের বাসিন্দার কথায়, ‘‘জীবনে প্রথম দেখলাম, তোর্সায় সারি দিয়ে ভেসে যাচ্ছে গন্ডার, বুনো শুয়োর, হরিণ! তাদের মধ্যে অনেকগুলো নদীতে ভেসে যাওয়া কাঠ আঁকড়ে ধরার চেষ্টা চালাচ্ছিল!”

অসমের কাজিরাঙায় প্রতি বছর বন্যায় গন্ডার-সহ বহু বন্যপ্রাণীর ভেসে যাওয়ার ঘটনা সংবাদমাধ্যমে দেখেছেন জাহির এবং তাঁর বাবা আমির হোসেন। তাঁদের প্রশ্ন, ‘‘এ বার থেকে কি জলদাপাড়াতেও তেমন শুরু হল!” যে আশঙ্কাকে অমূলক বলছেন না উত্তরের পরিবেশপ্রেমীরা। এই পরিস্থিতির পিছনে দুর্নীতি কাজ করছে বলে অভিযোগ তাঁদের।

ডুয়ার্স থেকে পাহাড়—বনাঞ্চলকে ঘিরে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। যুগের পর যুগ বন দফতরের নজর এড়িয়ে অবৈধ ভাবে বনাঞ্চলের গাছ কাটা চলছে। বনাঞ্চলকে ঘিরে তৈরি হচ্ছে উপনগরী, আবাসন। যত্রতত্র গড়ে উঠছে হোটেল-রিসর্ট। ফলে, সঙ্কুচিত হয়েছে জঙ্গল। অথচ, এ সবের অনুমতি কী করে মিলছে খোঁজ করতে গেলে স্থানীয় রাজনীতির চরিত্রদের কথাই সামনে আসে। বছর চারেক আগে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে বক্সায় বেআইনি ভাবে গাছ কাটার ঘটনায় তৃণমূলেরই এক নেতার নাম (সম্প্রতি প্রয়াত) উঠে আসে। তৃণমূল তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করেছিল।

অবৈধ ভাবে গাছ কাটার দৌলতে বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অনেক জায়গা কার্যত ফাঁকা হয়ে গিয়েছে বলে অভিযোগ। একই ধরনের অভিযোগ রয়েছে জলদাপাড়া, গরুমারা, বৈকুণ্ঠপুর বা মিরিকেও। পরিবেশকর্মী অরূপ গুহ বলেন, “বনাঞ্চলকে ঘিরে গত কয়েক বছরে বিকল্প শিল্প গড়ে উঠেছে। লুটেপুটে খাওয়ার শিল্প। সবচেয়ে বেশি ভুগছে বন্যপ্রাণীরা। সংশ্লিষ্টেরা যত দ্রুত বুঝবেন, মঙ্গল।” আর এক পরিবেশকর্মী শ্যামাপ্রসাদ পাণ্ডে বলেন, “জঙ্গল কিংবা লাগোয়া এলাকা বা ইকো-সেন্সিটিভ জ়োনে একের পরে এক নির্মাণ হচ্ছে। সরকারি উদ্যোগে জলপাইগুড়ির বামনডাঙায় যে ‘মডেল ভিলেজ’ গড়া হয়েছিল, সেটা কী করে হল, বুঝতে পারিনি। কারণ, ওই এলাকাটাও গন্ডারদের বিচরণভূমি!’’

বন দফতর সূত্রের খবর, চোরাকারবারিরা জঙ্গল থেকে কাঠ কাটতে ৪০-৫০ জনের দল নামায়। কাঠ বেচে পাওয়া মুনাফার বেশিটাই যায় বড় কারবারিদের হাতে। সেখান থেকে রাজনৈতিক নেতা ও বন দফতরের আধিকারিকদের একটা অংশের কাছে প্রণামী পৌঁছে যায় বলেই অভিযোগ। যাঁরা এই ‘সিস্টেম’-এ থাকতে চান না, তাঁরা হয় মুখ বুজে থাকেন, নয়বদলি হন।

রাজ্যের প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) সন্দীপ সুন্দরিয়াল ছুটিতে। ভারপ্রাপ্ত প্রধান মুখ্য বনপাল (বন্যপ্রাণ) পিয়ার চন্দ বলেন, “বনাঞ্চলে বন্যপ্রাণীদের সংখ্যা বাড়ছে। হয়তো সে অর্থে জঙ্গলের পরিধি বাড়েনি। সম্প্রতি উত্তরবঙ্গে যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়েছে, তা কারও হাতে ছিল না। ভুটান থেকে আসা নদীগুলোর জল যে এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে, তা কেউ ভাবতে পারেনি।” বন দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী বিরবাহা হাঁসদার দাবি, “যখন থেকে দায়িত্বে এসেছি, সর্বত্র ছুটে বেড়াচ্ছি। যাতে সবই নিয়ম অনুযায়ী চলে। এই মুহূর্তে তা চলছেও।”

বন দফতরের তৎপরতায় অবশ্য ভরসা রাখতে পারছেন না পরিবেশ সংগঠন ‘ন্যাফ’-এর কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বসু। তাঁর কথায়, ‘‘যে ভাবে তোর্সা নদীতে গন্ডার এবং বন্যপ্রাণী ভেসে যেতে দেখা গেল, আগামী দিনেও তা ধারাবাহিক ভাবে দেখতে হবে বলে আশঙ্কা হচ্ছে।’’ চিলাপাতার জঙ্গল ঘেঁষা এলাকার বাসিন্দা রসিকা রাভার টিপ্পনী, ‘‘দক্ষিণী সিনেমায় চোরাই কাঠ জলে ভাসিয়ে দেয়। এখানে কাঠ তো ভাসানো হয়ই, এখন বন্যপ্রাণও ভেসে যাচ্ছে।’’ (শেষ)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Darjeeling Jaldapara

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy