E-Paper

পরিযায়ী শ্রমিকের বেশে শেখা ‘রান্না’

পোস্তর আঠা থেকে ‘পুরিয়া’য় পরিণত কী ভাবে হচ্ছে? অভিযোগ, কালিয়াচকে মোজমপুর, নারায়ণপুর, নতুন শ্রীরামপুর, শাহবাজপুরের আম বাগান বা বাড়িতেই তৈরি করা হচ্ছে ব্রাউন সুগার।

অভিজিৎ সাহা

শেষ আপডেট: ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৭
An image of drugs

—প্রতীকী চিত্র।

গঙ্গা ভাঙনের সঙ্গে মাদক কারবারের যোগ কী ভাবে? মুচকি হাসেন পুলিশের এক প্রাক্তন কর্তা। বলেন, “ব্রাউন সুগারের বীজ বপন শুরু হয় গঙ্গা ভাঙন ঘিরেই। গঙ্গা যখন এক দিকে পার ভাঙছে, অন্য দিকে গড়ছে। ভাঙা-গড়ার মধ্যেই মালদহ-ঝাড়খণ্ড সীমানায় কালিয়াচকে গঙ্গায় গড়ে ওঠে ‘চর’। সে চরেই এক দশক আগে অবৈধ পোস্ত চাষ শুরু হয়।” পোস্তর আঠা ব্রাউন সুগারের কাঁচামাল।

নদীর চর হয়ে অবৈধ সে চাষ ছড়িয়ে পড়ে কালিয়াচক, বৈষ্ণব নগরের ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের গ্রামগুলিতে। কোথাও ভুট্টা, কোথাও পাটের জমির আড়ালে বেআইনি ভাবে পোস্ত চাষ হত। প্রশাসনের দাবি, ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত মালদহে হেক্টরের পরে হেক্টর জমিতে পোস্ত চাষ হয়েছে। প্রথম দিকে, নদিয়ার কালীগঞ্জ থেকে ঢোকা মাদক কারবারিরা জেলার সীমান্ত গ্রামের জমি লিজ নিয়ে পোস্ত চাষ করত। পরে, কালিয়াচকে মাদক কারবারিদের একাংশ পোস্ত চাষ শুরু করে।

পুলিশ জানিয়েছে, ২০১৬-১৭ পর্যন্ত কালিয়াচক, বৈষ্ণবনগরের পোস্তর আঠা উত্তরপ্রদেশ, পঞ্চাবের মতো রাজ্যে পৌঁছত। তবে এখন ভিন্ রাজ্য থেকে কাঁচামাল জেলায় আসছে, দাবি পুলিশ ও সিআইডি কর্তাদের। কোন পথে জেলায় আসছে ব্রাউন সুগারের কাঁচামাল? পুলিশের একাংশের দাবি, অসম, মণিপুর, মেঘালয়ের মতো রাজ্য থেকে শিলিগুড়ির মাটিগাড়া হয়ে, সড়ক পথে কালিয়াচক, বৈষ্ণবনগরে ঢুকছে পোস্তর আঠা। এ ছাড়া, ঝাড়খণ্ড থেকে মুর্শিদাবাদের ফরাক্কা হয়েও জেলায় আসছে সে জিনিস। রাস্তায় পুলিশের নাকা-চেকিং থাকলেও কেন ঠেকানো যাচ্ছে না মাদকের কাঁচামালের আমদানি? পুলিশের এক কর্তা জানান, জাতীয় সড়কে পণ্য ও যাত্রিবাহী বহু গাড়ি যাচ্ছে। সমস্ত গাড়িতে তল্লাশির মতো পরিকাঠামো নেই। সে সুযোগ নিচ্ছে মাদকের চোরা কারবারিরা।

পোস্তর আঠা থেকে ‘পুরিয়া’য় পরিণত কী ভাবে হচ্ছে? অভিযোগ, কালিয়াচকে মোজমপুর, নারায়ণপুর, নতুন শ্রীরামপুর, শাহবাজপুরের আম বাগান বা বাড়িতেই তৈরি করা হচ্ছে ব্রাউন সুগার। সিআইডির অভিযানে উদ্ধার হওয়া পৌনে ৪ কেজি ব্রাউন সুগার মিলেছে শুধু মোজমপুরেই। জানা যায়, পরিযায়ী শ্রমিক সেজে মণিপুর, মেঘালয়ে গিয়ে ব্রাউন সুগার তৈরির প্রশিক্ষণ নেয় কিছু মাদক কারবারি। এলাকায় ফিরে এসে তারা নতুনদের প্রশিক্ষণ দেয়। সে সুবাদেই গজিয়ে ওঠে মাদকের ‘রান্নাঘর’।

এক মাদক প্রস্তুতকারকের দাবি, ‘‘ব্রাউন সুগার তৈরির জন্য প্রয়োজন কিছু রাসায়নিকের। আঠা প্রথমে ফোটাতে হয়। পরে তা ছেঁকে, শুকিয়ে রাসায়নিক মিশিয়ে কাদার মতো ‘ক্রুড’ তৈরি করা হয়। ফের রোদে শুকিয়ে, তা থেকে পাউডারের মতো ব্রাউন সুগার বানানো হয়। সে পাউডার রাংতায় মুড়ে বানানো হয় পুরিয়া।’’

জমিতে বেআইনি ভাবে পোস্ত চাষের অভিযোগে তিন বছর জেল খাটতে হয় কালিয়াচকের মোজমপুরের সংলগ্ন গোলাপগঞ্জের এক পঞ্চাশোর্ধ্বকে। তাঁর অভিজ্ঞতা, “জমিতে রাতদিন খেটে আনাজ চাষ করলে, পাঁচ হাজার টাকা লাভ করতে হিমশিম খেতে হয়। অথচ, এক বিঘা জমিতে পোস্ত চাষ করলেই হাতে নগদ ২৫-হাজার টাকা। লোভে পড়ে ঝুঁকি নিয়েছিলাম। জেলে গিয়ে বুঝেছি, কত খারাপ কাজ করেছি।’’

জেলা পুলিশের এক কর্তা বলেন, “পোস্ত চাষ থেকে সাধারণ কৃষকদের দূরে রাখতে ভুট্টা, ডালের মতো বিকল্প চাষের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। বিনামূল্যে বীজ দেওয়া হয়েছে।” তাঁর সংযোজন, ‘‘শুধু আইন দিয়ে টাকার লোভ থেকে গরিব মানুষকে দূরে রাখা যাবে না। তাই বিকল্প আয়ের দিশাও দেখানোর চেষ্টা হচ্ছে।’’ (চলবে)

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Drugs Drug Smuggling Brown Sugar Malda Migrant Workers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy