ঋতু-উৎসব শব্দে যে প্রকৃতি বন্দনা রয়েছে, ধর্ম-ভাবনার বাইরে ‘আমি-তুমি-সে-আমরা’ মিলে যে আনন্দ উদযাপন হতে পারে, রবীন্দ্রনাথ তা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আনন্দ-উৎসব পালনে সু-সংস্কৃত ও মার্জিত রূপে প্রকৃতিকে অগ্রাধিকার দিলেন। শান্তিনিকেতন আশ্রমের ভিতরে ঢুকে থাকা বা পাশের আদিবাসী গ্রামগুলির মানুষ তাঁর চিন্তার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করলেন। আশ্চর্য এই যে, এর বাইরে থেকে গেল তাঁর আশপাশের জনগণ।
রাঢ়ের সুপ্রাচীন নিজস্বতা নিয়ে হয়তো তাঁরা রবীন্দ্রনাথের অতি সংবেদনশীল ভাবনার ভিতরে প্রবেশ করতে চাইলেন না। হয়তো এই কারণে আশ্রম লাগোয়া এলাকা থেকে ‘চড়াম চড়াম’ ঢাকের বাদ্যি বড় কানে এসে বাজে ইদানিং। রবীন্দ্রনাথ পাশের ঘরের মানুষ হয়েও তাঁদের অনেকের মস্তিষ্কে যথোপযুক্ত অক্সিজেন প্রবেশ করাতে পারলেন না। একে রবীন্দ্রনাথের, না যাঁরা তাঁকে হাতের কাছে পেয়েও গ্রহণ করতে পারলেন না, তাঁদের ব্যর্থতা বলে গ্রহণ করব, জানি না। আর আমরা যাঁরা গ্রহণ করলাম বলে খানিক আত্মশ্লাঘা বোধ করলাম, তাঁরাও কি আদৌ মনের ভিতর তাঁর কথাগুলি নিতে পারলাম?ধর্মের আচার-বিচার মুক্ত হয়ে তাঁকে একটি পরিমার্জিত রূপ দেওয়ার চেষ্টাই তো করলাম না। উৎসবের আনন্দ পরিণত হল মোচ্ছবে। নির্লজ্জ দেখানোপনার প্রতিযোগিতায় হতাশা ও তজ্জনিত অবসাদ গ্রাস করল। প্রকৃতিকে দৈনন্দিন জীবনের বাইরে ‘অপর’ করে দিলাম আমরা।
শারদ উৎসবের পথ খুলে দিয়েছিলেন তিনি। তাঁর দেখানো পথে হতে পারত সব ধর্মের মিলেমিশে আনন্দ উদযাপন। একদা হিন্দু স্বদেশীদের মা কালীর কাছে প্রণাম করে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার প্রথায় সহযাত্রী মুসলমানেরা নিজেদের বিচ্ছিন্ন মনে করেছিল। নিজের নিজের ধর্মপালনের পরেও কোন একটা জায়গায় তো আমাদের একত্রে আনন্দ উপভোগের উৎসব থাকার দরকার ছিল। অপরিচয়ে দূরত্ব বাড়ে। সেই দূরত্ব মেটানোর জন্য আমরা নতুন করে কোনও ভাবনাচিন্তা করলাম না।
বাঙালির জন্যে আদর্শ পথ হতে পারত শারদোৎসব, বিশ্বকর্মা পুজোর সঙ্গে সঙ্গে শিল্পোৎসব, বর্ষার বর্ষামঙ্গল, নর্দমার রঙের বদলে বসন্ত উৎসব। যদিও বিচ্ছিন্ন ভাবে বসন্ত উৎসব এবং নববর্ষ পালনের একটা জোয়ার এসেছে, তবুও প্রকৃতিলগ্ন উৎসব আরও বেড়ে উঠলে প্রতিটি সম্প্রদায়ের মধ্যে যোগাযোগ বাড়তে পরে। এগুলি জোরালো হয়ে উঠলে বর্শা-মুগুর-লাঠি-ছোরা প্রভৃতি খোলা অস্ত্র নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন ধর্মের প্রতিযোগিতামূলক শৌর্যের আস্ফালন পিছু হটবেই। প্রাথমিক উত্তেজনা কেটে গেলে আনন্দময় বিকল্পকে মানুষ গ্রহণ করতেও পারে।
একটি ভাইরাল ভিডিয়োর কথা মনে পড়ছে। শ্রদ্ধেয় ও সুবিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব, মণিপুরের মানুষ রতন থিয়ামের শেষ শয্যায় তাঁর পৌত্রী রবীন্দ্রনাথের গান শোনাচ্ছে। সেই কবে মণিপুরের চিত্রাঙ্গদাকে তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ত্রিপুরার রাজপরিবারের কল্পকাহিনী কত ভাবেই না তাঁর লেখায় এসেছে। যে উত্তর-পূর্বকে আমরা মূল ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবে অজান্তেই দূরে ঠেলে রাখি। রবীন্দ্রনাথ দেখিয়েছিলেন লেখকের দায়িত্বপালন রাজনীতির মানুষের থেকেও অনেক বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। তিনি পথ দেখিয়েছিলেন। আমরা সে পথ গ্রহণ করিনি। গলার মালাটি পরিয়ে গুরুদেব নামে আরেকটি মাটির ঠাকুর বানিয়েছি মাত্র। প্রয়াণ দিবসে তাঁকে স্মরণ করতে হলে শুধু তাঁর গান, কবিতা ব্যক্তিগত আশ্রয়ে থাকলেই চলবে না, মনে রাখতে হবে তিনি ছিলেন সমষ্টির কন্ঠস্বর।
সেই আমলে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে নাইট উপাধি ত্যাগ করা বড় সহজ ছিল না। আমরা যাঁরা সামান্য উৎকোচে বশীভূত হই, তাঁকে বুঝবোই বা কেমন করে? ‘সভ্যতার সঙ্কট’ লিখে জাপানে তিনি মোটেই আগের মতো সাদরে গৃহীত হননি। বারবার পরিণত বয়সের স্থিতাবস্থা নিজেই বিপন্ন করেছেন তিনি। এমন প্রতিবাদী কবি মানুষটিকে আমরা যেন পূজার ছলে দূরে সরিয়ে না দিই।
সাহিত্যিক ও শিক্ষিকা, শিলিগুড়ি
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)