কাজী নজরুল ইসলাম স্বতন্ত্র। বাঙালির তুলনাদণ্ডের পাল্লা-পাথরের বাইরে কতটা উদযাপিত নজরুল, তা প্রশ্নের। নামের বাইরে গিয়ে তাঁর কাজ নিয়ে চর্চা ও চর্যা কত, সে প্রশ্ন বছরের এই সময়ে শৌখিন বক্তব্যের মতো শোনায়। তবু বার কয়েকের শৌখিনতা ধীরে ধীরে আত্মা স্পর্শ করলে, অজস্র প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্নের সমান্তরালে এই অসময়েও যদি কোনও এক ভিন্নতর পথের সন্ধান মেলে, সেই আশাতেই এমন জ্যৈষ্ঠে নজরুলকে মনে করতে পারি আমরা। যা ধারাবাহিক চর্চাতেই গতি দেবে।
এই দু’মাস রবীন্দ্র-নজরুলের। এ ভাবেই উচ্চারিত হন রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল। আমাদের অস্ত্র ও বর্ম। যেখানে বিদ্বেষ নেই, দেশ আছে। তা হলে কি দেশ মানে শুধু মাটি? সময়ের সঙ্গে সময়ের ধূসর বড় গাঢ় হয়ে আসে। আমাদের আশ্রয়স্থল তাই কখনও নড়ে ওঠে বিষে ও বাষ্পে। আজও এমনই এক সময়।
মেনে নেওয়া আর মানিয়ে নেওয়ার এই সময়েও নজরুলের জীবন ও কাজ এতটা স্বকীয়, যা সময়কে ধাক্কা দেয় এবং বাঁচিয়ে রাখে। নজরুলের প্রসঙ্গ এলেই দারিদ্র্যের প্রসঙ্গ আসে, বিপ্লব বিদ্রোহের প্রসঙ্গ, স্বাধীনতা, ভেঙে পড়া ও ঘুরে দাঁড়ানো, শিল্পে ও সাহিত্যে মানুষকে একক করে তোলা, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতা ও অন্যান্য। কাজী নজরুল ইসলামের জন্মের ১২৬ বছরে এসেও আমরা কি এ সব প্রশ্ন এবং প্রতিপ্রশ্নকে যুঝে নিতে ততটাও প্রস্তুত?
২৪ মে ১৮৯৯। চুরুলিয়ায় নজরুল ইসলামের জন্ম। প্রাতিষ্ঠানিক পাঠের চেয়েও গভীর, জীবনের পাঠ নিয়েছেন তিনি। আসলে বাংলার মাটি তাঁকে গড়ে তুলেছিল। গ্রামীণ সংস্কৃতির বর্ণময় লোটো গান, যে গানের দলে তাঁকে যোগ দিতে হয় সংসারের হাল ধরতে।
ভেতরে এ ভাবেই কবিতার ভূমি উর্বর হতে শুরু করেছিল। এ সমস্ত রেখায় হঠাৎ ছেদ। তিনি যোগ দিলেন সেনাবাহিনীতে। জীবনে এত রেখা এত কোণ গড়ে তুলল, প্রিজ়মের মতো প্রতিফলিত হতে শুরু করল তাঁর বহুবর্ণ জীবন।
এরই মধ্যে বিদ্রোহ রচিত হচ্ছে। নজরুল পৌঁছেছেন খ্যাতির শিখরে। প্রকাশিত হচ্ছে ধুমকেতু পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ আশীর্বাদ সূচক লিখছেন, ‘‘... দুর্দিনের এই দুর্গ শিরে/ উড়িয়ে দে তোর বিজয়কেতন।’’ ক্রমে রাষ্ট্রদ্রোহিতার প্রসঙ্গ আসতে থাকে। এমনকি কারাবাস হয়। সমান্তরালে তিনি লিখছেন বিদ্রোহের কথাই। তা ছড়িয়ে পড়ছে মানুষ থেকে মানুষে।
প্রায় তিন হাজার গানের স্রষ্টা নজরুল শুধু কবি নন। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় তিনি নিজেকে প্রমাণ করেছেন। সাংবাদিকতা এবং রাজনীতিতেও। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীত, লোকসংগীত, গজল থেকে শ্যামাসঙ্গীত। এই শাক্তভূমিতে দাঁড়িয়ে ত্রিভুজের তিনটি বিন্দুতে স্থাপন করেছেন জাতিসত্ত্বা, বিপ্লববাদ এবং শ্যামাসঙ্গীতকে। সময়ে দাঁড়িয়ে সময়ের অবয়বকে অস্বীকার করেছেন নজরুল। আবার গড়েও তুলেছেন।
শিক্ষক, কোচবিহার
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)