Advertisement
E-Paper

লাঠি হাতেই খালে স্নান

শনিবার বাঘ ধরতে এলাকায় ‘ফরেস্টারবাবু’, ‘পুলিশবাবুরা’ এসেছেন। তাই কেউ কেউ সাবান মেখে একটু সময় নিয়ে স্নান করছেন। আর সকলেই বলছেন, জঙ্গল এলাকায় হাতি, বুনোশুয়োর, হরিণ, বনবিড়াল, সাপ নিয়ে ঘর করতে হয়।

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০৪ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
ত্রস্ত: যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা! তাই মধুপুর খালে স্বামী যখন স্নান করছেন, পাহারায় স্ত্রী।ছবি: কিংশুক গুপ্ত

ত্রস্ত: যদি ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা! তাই মধুপুর খালে স্বামী যখন স্নান করছেন, পাহারায় স্ত্রী।ছবি: কিংশুক গুপ্ত

বছর পঞ্চাশের নির্মল মাল স্নান করছিলেন কুমারবাঁধ গ্রাম লাগোয়া মধুপুর খালে। পাড়ে দাঁড়িয়ে সনকা মাল স্বামীকে তাড়া দিচ্ছিলেন, “আর মাথায় সাবান ঘষতে হবে না। উঠো এসে। বাঘ এসে পড়লে সাতজন্মের স্নানের শখ ঘুচে যাবে।”

খালের জলে জোড়া মোষ স্নান করাচ্ছিলেন কুমারবাঁধের বৃদ্ধ অনাদি মাল। খাল পাড়ের জমিতে রোয়া কচি ধান দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘‘গত রাতে হাতি এসে ক্ষতি করে গেল। এখন আবার বাঘের ভয়। কিন্তু আমার মোষ যে স্নান না করে থাকতে পারে না। তাই নিয়ে এসেছি।” শুধু অনাদিবাবুরা নন। গ্রামের খোকন মাল, কার্তিক সরেনদের মতো যুবকেরা লাঠি হাতে স্নানে যাচ্ছেন।

শনিবার বাঘ ধরতে এলাকায় ‘ফরেস্টারবাবু’, ‘পুলিশবাবুরা’ এসেছেন। তাই কেউ কেউ সাবান মেখে একটু সময় নিয়ে স্নান করছেন। আর সকলেই বলছেন, জঙ্গল এলাকায় হাতি, বুনোশুয়োর, হরিণ, বনবিড়াল, সাপ নিয়ে ঘর করতে হয়। কিন্তু বাঘের মোকাবিলা করা অসম্ভব। তাই গত এক সপ্তাহ গরু-ছাগল জঙ্গলে চরানোর সাহস পাচ্ছেন না এলাকাবাসী।

অথচ জঙ্গলের শুকনো ডালপাতা কুড়িয়েই জ্বালানি জোগাড় হয়, জঙ্গলে গরু-বাছুর চরে বেড়ায়। সে সব
এখন বন্ধ।

কুমারবাঁধ জুনিয়র হাইস্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র কার্তিক টুডু, কুমারবাঁধ প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির পড়ুয়া মোহন মাণ্ডিরা শুকনো মুখে বাড়িতেই রয়েছে। এই দুই স্কুল পড়ুয়ার বাড়ি ছোটপেলিয়া গ্রামে। মোহন, কার্তিকরা বলে, “মাঠে খেলতে যেতে পারছি না। বাঘ ধরা না পড়া পর্যন্ত স্কুল যেতে নিষেধ করছেন অভিভাবকরা।” ছোটপেলিয়ার লক্ষ্মীমণি মাণ্ডি বলেন, “কোন ভরসায় ছেলেমেয়েকে স্কুলে পাঠাই বলুন তো। জঙ্গলে শালপাতা ঝরার শব্দেও মনে হচ্ছে এই বুঝি বাঘ এল।”

তিন-চার সপ্তাহ আগে জঙ্গলে হিংস্র প্রাণীর উপস্থিতি টের পাওয়া গিয়েছিল। আমলিয়া গ্রামের এক বাসিন্দার কয়েকটি গরু থাবার আঁচড়ে জখম হয়েছিল। কয়েকটাকে গরু নিখোঁজ হয়েছিল। দিন সাতেক আগে মেলখেরিয়া গ্রামের বাসিন্দা গোপীনাথ মুর্মু জঙ্গলে গরু চরানোর সময় বাঘের দেখা পান বলে দাবি।

গায়েন মুর্মুর গরু মেরেও সাবাড় করেছিল হিংস্র প্রাণিটি। শুক্রবার বন দফতরের গোপন ক্যামেরায় ওঠা বাঘের ছবি টিভিতে দেখেছেন অনেকে। লোকমুখে সে কথা চাউর হয়েছে জঙ্গল লাগোয়া প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতেও। আর পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভয়।

এক সময় ছোটপেলিয়ায় দাপিয়ে বেড়াত মাওবাদীরা। বছর দশেক আগে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে এই গ্রামের বৃদ্ধা ছিতামণি মুর্মুর ‘চোখ নষ্ট’ হওয়ার অভিযোগে মাওবাদী আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। তখন এলাকাবাসীকে মাওবাদীদের বন্দুকের নলের মুখে ‘প্রতিবাদ মিছিলে’ মাইলের পর মাইল হাঁটতে হতো। সে সব আতঙ্কের দিনলিপি। এখন হানাদার বাঘ এসে ফের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। বাড়ির উঠোনে বসেছিলেন ছোটপেলিয়ার অর্জুন হেমব্রম। উঠোনে বাঁধা গরু-ছাগল। তারা কাঁঠালপাতা আর বিচালি চিবোচ্ছে। অর্জুনবাবুকে দেখিয়ে প্রতিবেশী বৃদ্ধ নব্বই ছুঁইছুঁই উপেন মাণ্ডি বলেন, “বাঘ তো এলাকায় ষাট-সত্তর বছর আগে ছিল। তারপর এক দু’বার গুজব ছড়ালেও বাঘ আছে এমন প্রমাণ মেলেনি। কিন্তু বন দফতরের ছবি দেখার পরে খুব ভয় করছে।

কুমারবাঁধের কাঁদন সরেন, সুরেন্দ্রনাথ হাঁসদারা তড়িঘড়ি চাষজমি থেকে গ্রামে ফিরছিলেন।

দু’জনেই বললেন, “জমিতে জল সেচ দিতে এসেছি। তবে বেশিক্ষণ মাঠে থাকছি না।” আতঙ্ক ছড়িয়েছে জঙ্গল লাগোয়া বীরকাঁড়, আমলিয়া, বড় পেলিয়া, পডিহার মতো গ্রামগুলিতেও।

সূর্য ডোবার আগেই ঘরে সেঁধিয়ে যাচ্ছেন জঙ্গল লাগোয়া গ্রামের বাসিন্দারা। এলাকাবাসীকে ভরসা দিতে ব্লক প্রশাসন ও বন দফতরের গাড়ি থেকে চলছে মাইক-প্রচার। ডিএফও (মেদিনীপুর) রবীন্দ্রনাথ সাহা আপাতত লালগড়েই রাত কাটাচ্ছেন। তিনি বলেন, “এলাকাবাসীকে আপাতত জঙ্গলে যেতে বারণ করা হয়েছে। বনকর্মীরা সতর্ক আছেন। গ্রামবাসীদেরও সতর্ক-সচেতন থেকে বন দফতরের সঙ্গে সহযোগিতা করার অনুরোধ করা হচ্ছে।”

Lalgarh Tiger লালগড় বাঘ
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy